শীতের আগমনী বার্তা: নওগাঁয় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে প্রবীণরা!

কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ:

প্রকৃতির অঘোর নিয়মে শীতের আগমনী বার্তা কড়া নাড়ছে মানুষের দোড় গোড়ায়। উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ জেলায় এখনও শীতের প্র্যাবল্য দেখা না দিলেও সকাল ও সন্ধ্যায় অনুভুত হচ্ছে হালকা শীত।
এ সময়গুলোতে মানুষকে হালকা শীতবস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। শীতের এই আগমনী বার্তায় সামর্থ্যবান মানুষরা নিবারণ প্রস্তুতি শুরু করলেও দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষরা এখনও এ বিষয়ে কোন প্রকার আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেনি।
প্রকৃতির নিয়মতান্ত্রিকতায় শীত মৌসুম যেমন আসন্ন তেমনি প্রতিটি মানুষের জীবনে বার্ধক্যও আসন্ন। প্রবীণ বয়সে একজন মানুষ তাঁর শক্তি, সামর্থ, প্রভাব, প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলে। নিজ বাড়িতেই ছেলে-মেয়ে বা অন্য কাহারো অধীনস্ত হয়ে সে পরগাছার মতো জীবণ যাপন করতে বাধ্য হয়।
এক সময় প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে যে মানুষটি পরিবার শাসন করতো এক সময় সেই একই পরিবারে প্রবীণ মানুষটি মুল্যহীন হয়ে পড়ে।

 
বুকে অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে সব কিছু মুখ বুঁজে সহ্য করা ছাড়া তাঁর যেন আর কিছুই করার থাকে না। প্রতি বছর শীত মৌসুম এলেই দৈনিক পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের বদৌলতে আমরা ছিন্নমুল মানুষের দূর্দশার চিত্র দেখতে পাই। কিন্তু অতি অসহায় প্রবীণদের শীত জনিত সমস্যাগুলো বিশেষ ভাবে আমরা দেখতে পাই না।

 
শীত মৌসুমে শীতের সমস্যা ছাড়াও প্রবীণরা ঠান্ডা জনিত ডায়রিয়া, এ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট সহ নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পরিবারে সবচেয়ে কমদামী বা বাতিল শীতবস্ত্রটিই প্রবীণ মানুষের জন্য বরাদ্দ থাকে।

 
অনুরুপভাবে প্রবীণদের থাকার স্থানটিও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চেয়ে আলাদা হয়। শীত নিবারণের প্রয়োজনীয় উপযুক্ত গরম পোষাক সংকট ও থাকার জন্য মানসম্মত স্থান না থাকায় প্রবীণরা নানাবিধ শীত জনিত সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। যা অনেক সময় তাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

 
২০১৩ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্ত্তৃক প্রণীত জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী দেশের ষাট বা তদুর্ধ ব্যক্তিরাই হলেন প্রবীণ। ২০১১ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা মোট ১৬ কোটি। এর মধ্যে শতকরা ৮ ভাগ প্রবীণ।

 
এ হিসাবে বাংলাদেশে প্রবীণ তথা ষাটোর্ধ নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায়  ১ কোটি ৩০ লাখ। শুমারী অনুযায়ী নওগাঁ জেলার মোট জনসংখ্যা ২৬ লাখ ১শত ৫৭জন। অর্থাৎ নওগাঁ জেলায় মোট প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ২ লাখ।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের গড় আয়ু। তাই প্রবীণ মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

 

হেল্পএইজ ইন্টারন্যাশনাল এর এইজওয়াচ ইনডেক্স ইনসাইট রিপোর্ট ২০১৫ এর অনুসারে বর্তমানে বিশ্বব্যাপি প্রায় ৯০১ মিলিয়ন মানুষ প্রবীণ, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১২.৩%. এই প্রবীণ সংখ্যা ২০৩০ সাল নাগাদ বেড়ে দাঁড়াবে ১৬.৫%, যা ২০৫০ সালে দাঁড়াবে  ২১.৫% এ. বাংলাদেশে এ সংখ্যা ২০৩০ সালে দাঁড়াবে ১১.৫%, যা ২০৫০ সালে হবে ২১.৫% । ২০৫০ সাল নাগাদ প্রবীণের সংখ্যা ১৫ বছরের শিশুর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে। ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি ১০ জনে ৮ জন হবেন ৬০ বা তার উর্দ্ধের বয়সের মানুষ।

 
প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতায় আমাদের সকলকে একদিন প্রবীণে উপনীত হতে হবে। তাই পরিবার ও সমাজে আমরা যদি প্রবীণদের মর্যাদা ও সুরক্ষার চর্চা শুরু না করতে পারি তাহলে আমাদের সকলকেই একদিন একই ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।

 
শীতকালীন সময়ে প্রবীণদের পারিবারিক সুরক্ষার বিষয়ে বিশিষ্ট চিকিৎসক মির্জা শাকিল আহমেদ জানান, শীতে প্রবীণদের উপযুক্ত গরম কাপড় সরবরাহের পাশাপাশি যেটি দরকার তা হলো- থাকার জায়গাটা এমন হওয়া দরকার যেখানে বাতাস প্রবেশ করবে না, গোসল বা পানের জন্য প্রয়োজনীয় গরম পানির সরবরাহ করা এবং তাদের প্রতি যত্নবান হওয়া।

 
এ বিষয়ে নওগাঁ জেলায় প্রবীণ অধিকার সুরক্ষায় কর্মরত বেসরকারি সংগঠন বরেন্দ্রভূমি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (বিএসডিও)’র নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রউফ সিল্কসিটি নিউজকে জানান, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে ও হেল্পএইজ ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ এর কারিগরী সহায়তায় বিএসডিও নওগাঁ জেলায় প্রবীণ অধিকার সুরক্ষায় সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া ক্যাম্পেইন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

 
ক্যাম্পেইনের পাশাপাশি প্রতি বছর শীত মৌসুমে দাতা সংস্থার সহায়তায় অসহায় প্রবীণ ও শিশুদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। চলতি শীত মৌসুমে দাতা সংস্থার  নিকট শীতবস্ত্রের জন্য আবেদন করা হবে বলেও তিনি জানান।

 
জন্মিলে মরিতে হইবে এ কথা যেমন চিরন্তন সত্য, তেমনি চরম বাস্তবতা হলো অনাকাংখিত মৃত্যু না হলে আমাদের সকলকে একদিন প্রবীণে উপনীত হবে। আমরা পরিবার ও সমাজে প্রবীণদের প্রতি যে ধরণের আচরণ করবো আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম তাই শিক্ষা লাভ করবে। আমাদের সকলের উচিৎ ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার স্বার্থে প্রবীণদের জন্য একটি নিরাপদ সমাজ গড়ে তোলা।

স/শ