ল্যান্ডমাইনে বিচ্ছিন্ন রোহিঙ্গা কিশোরের হাত-পা, কান্নার শক্তিটুকুও নেই তার

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আজিজুল হক নামের এক হতভাগা ভয় আর তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করতে চাইছে। কিন্তু সেই শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। সে ইতিমধ্যে তার জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। মিয়ানমার থেকে পরিবার নিয়ে পলানোর সময় একটা ল্যান্ডমাইনে পা পড়ে এই রোহিঙ্গার। মুহূর্তেই বিস্ফোরণ। দেহ থেকে অঙ্গ ছিন্ন হয়ে গেছে তার।  মাত্র ১৫ বছরের এই কিশোরের দেহ-মনে আর কত যন্ত্রণা সহ্য হয়!

এখন সে এতটাই দুর্বল যে মায়ের কাছে একটা জুস খাওয়ার ইচ্ছার কথাও বলতে পারছে না। আরেকটি চিন্তা হয়তো কাজ করছে প্রায় অচেতন মস্তিষ্কে। কিছু কিনে দেওয়ার সাধ্যও তো তার মায়ের নেই। আজিজুল এখন কক্স বাজারের একটি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত তার ব্যান্ডেজে মোড়া।

দুটো পা খুইয়েছে সে। এক হাতের কিছু অংশ উড়ে গেছে। গোটা দেহে ক্ষত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

তার মা রাশিদা বেগম বলেন, ‘আজিজুলের একটা পা মাইনে পড়ে। আমরা বিকট আওয়াজ শুনতে পাই। আমি চোখের সামনে দেখলাম আমার ছেলের দুই পা উড়ে গেলো। ‘ ছেলের বিছানার পাশে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে এসব কথা বলতে থাকলেন মা।

ডনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিদার এই পরিবারটি আরো ৩ লাখ ৭৯ হাজার রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি পরিবার। যারা জীবন বাঁচাতে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়েছেন। এসেছেন বাংলাদেশে। ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে মিয়ানমারের শাসকদের এই হত্যা অভিযান। দেবিন্না গ্রাম থেকে পালিয়েছেন তারা। সীমান্তের কাছে কাঁটাতারের বেড়া পেরোনোর সময় ল্যান্ড মাইনে পা পড়ে তার ছেলের।

চার সন্তানের জননী আরো বলেন, আরো অনেক রোহিঙ্গা দলে দলে ছুটছিল। তাদের পেছনে বন্দুক হাতে ঘাতকরা ছুটে আসছে। কারোরই সময় নেই অন্য কাউকে দেখার।

অসংখ্য রোহিঙ্গা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আর বৌদ্ধদের হত্যাযজ্ঞ আর ধর্ষণের ভয়ংকর কাহিনী তুলে ধরেছেন। এতকিছু হজম করে যখন তারা স্রেফ প্রাণ বাঁচাতে ছুটছেন, তখন শেষ হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে ল্যান্ডমাইন।

বাংলাদেশের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ডন জানায়, তারা মনে করেন যে এসব অ্যান্টি-পারসোনেল মাইন ১৯৯৭ সালে এক গ্লোবাল ট্রিটির মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের রুখতে এই মাইন ব্যবহার করছে মিয়ানমার জান্তা।

বিজিবি’র কমান্ডার মঞ্জুরুল হাসান খান এএফপি’কে জানান, সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ থেকে আমরা প্রায় ১২টি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের আওয়ার পেয়েছি। এতে অন্তত ৩ জন নিহত এবং ৭ জন গুরুতর আহত হয়েছেন।

রোহিঙ্গারা যে পথে পালাতে পারেন, ঠিক সেই পথের শেষ প্রান্তে মাইনগুলো পুঁতে রাখা হয়েছে বলে জানান অ্যামনেস্টি ইন্টরন্যাশনালের তিরানা হাসান।

‘পতনমুখী রাষ্ট্র’
গত বুধবার মিয়ানমারের এই মানবিক সংকটের প্রেক্ষিতে অবশেষে মুখ খোলে জাতিসংঘ। এই হত্যাযজ্ঞের ইতি টানার আহ্বান জানায় তারা। দেশটিতে অসংখ্য রোহিঙ্গা পরিবার দীর্ঘকাল ধরে বংশ পরম্পরায় বাস করছেন। এমন ১.১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন। অথচ দেশটিতে রোহিঙ্গা নিধন চলছে। মিয়ানমার এক পতনমুখী রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে।

ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ শরণার্থী হিসাবে তাদের জায়গা দিয়েছে। বর্ডার গার্ডস আজিজুলের এমন অবস্থা দেখে পরিবারটিকে ঢুকতে দিয়েছে। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। তার মা রাশিদা জানান, সীমান্তের একটি ক্লিনিকে আজিজুলকে নেওয়া হলে তাকে দ্রুত হাতপাতালে পাঠায় চিকিৎসকরা।

কয়েক দফা অস্ত্রোপচার হয়েছে আজিজুলের দেহে। চিকিৎসকরা এই কিশোরের জীবন বাঁচাতে খুব বেশি আশাবাদী নন। তার প্রায় সবই শেষ হয়ে গেছে। এখন তার রক্ত পরিবর্তনের জন্য রক্ত খুঁজছে হাসপাতাল। দেহের ৯০ শতাংশ রক্তই নষ্টের পথে।

আজিজুল এমনই আরো কমপক্ষে ২০ জন রোহিঙ্গাদের মধ্যে একজন যারা গুলি, আগুন আর বোমার ক্ষত নিয়ে কোনমতো বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। তারা কক্স বাজার চ্যারিটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

আজিজুলের যেখানে দেহ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে, তার কাছাকাছি আরেকটি ল্যান্ডমাইনে দারুণ আহত হয়ে বাংলাদেশে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৫০ বছর বয়সী সাবেকুন নাহার। এখন বাংলাদেশে চিকিৎসার পর তিনি হাঁটতেও পারছেন। দু চোখ মুছতে মুছতে বললেন, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না যে আমি আবারো হাঁটতে পারছি।