লোডশেডিং চলবে ২০২৬ পর্যন্ত

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

দেড় দশকে দেশের বিদ্যুৎ খাতে প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে। এ সময়কালে ৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা থেকে ২৬ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। হাতেগোনা কয়েকটি উৎপাদনকেন্দ্র থেকে প্রায় দেড়শ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি গ্রামে সংযোগের মাধ্যমে দেশজুড়ে শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের সেবাপ্রাপ্তি নিয়ে মানুষের প্রত্যাশাও বেড়েছে।  গ্রাহকরা এখন প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা পেতে চান।

এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা পেতে অন্তত ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কারণ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিপুল অংকের অর্থ বিনিয়োগ, প্রাথমিক জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলো জড়িত। এসব কারণে কমপক্ষে ২০২৬ সাল পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের সঙ্গেই থাকতে হবে বিদ্যুৎ বিভাগকে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ২০২২ সালের ২১ মার্চ সংবিধান অনুযায়ী মানুষকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ শেষ করেছে সরকার। এখন রূপকল্প ও সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী মানসম্পন্ন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা দিতে কাজ করছে সরকার। তিনি বলেন, সরকার প্রথমে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎসেবা পৌঁছে দিয়েছে। এখন মানুষ বিদ্যুতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে মানসম্পন্ন বিদ্যুৎসেবা প্রাপ্তির।

সবাই এখন রোজ ২৪ ঘণ্টাই বিদ্যুৎসেবা প্রত্যাশা করছে। তিনি বলেন, সেই সেবা দিতেও নানা কর্মযজ্ঞ চলছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার আগেই সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে সঞ্চালন, বিতরণ ও কারিগরি কর্মকা- যুগোপযোগী করার কাজ চলছে।

মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী বিদ্যুৎসেবা প্রদানের সঙ্গে বেশ কিছু বিষয় জড়িত। যার মধ্যে রয়েছে- প্রাথমিক জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করা, সারাদেশে সঞ্চালন, বিতরণ, সাবস্টেশন নির্মাণ ও কারিগরি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ। তিনি বলেন, নিয়মিত জ্বালানি জোগানের বাইরেও অন্তত আরও ১৫/২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। সেটা সরকার ক্রমান্বয়ে করছে।

শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি লোডশেডিং হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এর কারণ হলো- গ্রামে বিতরণ-সঞ্চালন লাইন নানা কারণে বিচ্ছিন্ন হয়। গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ে, মেরামত করতে সময় লাগে, কখনো কখনো দুর্বল সঞ্চালন-বিতরণ ব্যবস্থার কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায় না।

চলমান দাবদাহে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। ফলে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে কষ্ট আরও বেড়েছে। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহে ঘাটতি থাকায় লোডশেডিং হচ্ছে। তবে শহরে তুলনামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি ভালো থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বা গ্রামে লোডশেডিং বেশি হচ্ছে। গ্রামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। এমন অবস্থার মধ্যেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। গত সোমবার রাত ৯টায় এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে পিডিবি।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্যে দেখা যায়, গতকাল দিনের সর্বোচ্চ চাহিদা পূর্বানুমান সাপেক্ষে ছিল ১৫ হাজার মেগাওয়াট; উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৬২ মেগাওয়াট। সন্ধ্যায় চাহিদা ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট; উৎপাদন ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট। তবে পিজিবির তথ্য বলছে- গতকাল দুপুর তিনটায় চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট, উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ২০২ মেগাওয়াট; লোডশেডিং হয়েছে এক হাজার ৪৯ মেগাওয়াট। সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত গড়ে এক হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং ছিল। যদিও উৎপাদন ও চাহিদার যে হিসাব পিডিবি ও পিজিসিবি করে থাকে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পিজিসিবির এক কর্মকর্তা বলেন, সব সময় উৎপাদন ও চাহিদার হিসাবে সামান্য ব্যবধান রাখা হয়; কিন্তু প্রকৃত চাহিদা অনেক বেশি।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ৬টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির মাধ্যমে সারাদেশে বিদ্যুৎ বিতরণ করা হয়। যার মধ্যে সর্বাধিক ভোগান্তিতে আছেন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) আওতাধীন গ্রাহকরা। সারাদেশে বিদ্যুতের যে সংখ্যক গ্রাহক, তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই প্রত্যন্ত অঞ্চল বা গ্রামের; যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আরইবির আওতাধীন সমিতিগুলো। এসব সমিতি কখনই চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ পায় না। ফলে লোডশেডিং লেগেই থাকে। কোথাও কোথাও লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত। বিদ্যুৎসেবার তুলনামূলক বিচারে এগিয়ে আছে রাজধানীর দুটি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি- ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ।

উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী জাকিউল ইসলাম বলেন, নেসকো এলাকায় তুলনামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি ভালো। তিনি বলেন, যে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়, এর বড় অংশই নেসকো এলাকায় সরবরাহ হয়ে থাকে। তবে সঞ্চালন ও বিতরণ ত্রুটির কারণে লোডশেডিংও আছে।

নেসকো সূত্রে জানা যায়, রংপুর অঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে তিন-চার ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়। তবে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেশি। দিনের বেলা কিছুটা কম হলেও রাতে বেশি। ঢাকার বাইরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পিডিবি, ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বা ওজোপাডিকো, নেসকো ও আরইবি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন আরইবির গ্রাহকরা। মোট বিদ্যুৎ গ্রাহকের ৫৫ শতাংশই এ সংস্থার অধীনে। ওজোপাডিকোর আওতাধীন এলাকায়ও লোডশেডিং হচ্ছে বলে জানা যায়। তবে বিগত কয়েক বছর যাবৎ সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে ময়মনসিংহ অঞ্চলে। পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ওই অঞ্চলে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে কম। এ ছাড়া সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের নির্মাণকাজ চলছে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হতে আরও বছরখানেক লাগবে।

এদিকে গতকাল পিজিসিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ চাহিদার সর্বোচ্চ এ সময়কালে ২৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারকাজের জন্য বন্ধ রয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটাই স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে। এ ছাড়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চলছে। তবে তরল জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম চালানো হচ্ছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের বকেয়া বিল ঠিকমতো পরিশোধ করতে না পারায় অনেকে জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারেনি। ফলে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পুরোদমে উৎপাদন করা যাচ্ছে না।

এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। বৈশি^ক তাপমাত্রা যে হারে বাড়ছে, তাতে বিদ্যুতের চাহিদা আরও বাড়বে। তিনি বলেন, এসি ব্যবহার এখন আর বিলাসিতা নয়। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে গরমে এসি ব্যবহার করতে হবে। এই যে পরিবর্তন, এগুলোর সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদাও সম্পৃক্ত। তিনি বলেন, এ ছাড়া সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। ফলে বিদ্যুৎ খাতে আগামী দিনে অন্তত ৪০ বিলিয়ন ডলার নতুন বিনিয়োগ লাগবে। তিনি মনে করেন, আরও অন্তত এক দশক লাগবে স্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি তৈরি হতে।