লন্ডনের বাসে ঘুমিয়ে একুশ বছর

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

লন্ডন শহরের বাসে ২১ বছর রাতে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে নাইজেরিয়ান এক নাগরিক। আর সেই অভিজ্ঞতার কারণে তার পরিচয় হয়ে গেছে ‘নাইট রাইডার’। নাম তার সানি (ছদ্মনাম)।

রাত যখন ৩/৪ টা বাজে সানি প্রায়ই বাসে তিন ধরনের মানুষ দেখতে পান। তিনি আঁচ করতে পারেন, এদের একটি গোষ্ঠী পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করেন।

ভোর শুরুর আগেই তাদের কাজ শুরু হয়। ভাল জীবনের আশায় তারা লন্ডনে এসেছেন। আরেকটি গোষ্ঠী নাইটক্লাবে হৈ হুল্লোড় করে বাড়ি ফেরা আদি বৃটিশ।

উচ্চস্বরে গল্প করছেন আর গপগপ করে ফাস্ট ফুড খাচ্ছেন। সর্বশেষ গোষ্ঠীটি গৃহহীন, যাদের যাওয়ার কোন জায়গা নেই।

লন্ডনের বাস তাদের বিশ্রামের যায়গা। বাসের এমন পরিবেশ ধীরে ধীরে উপভোগ করতে শিখেছেন সানি। তাদের হাসি ঠাট্টার সাথে তিনি নিজেও মাঝে মাঝে যোগ দেন।

দুই দশকের বেশি আগে যুক্তরাজ্যে বসবাসের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন সানি। সম্ভবত সেই আবেদন যখন যাচাই করা হচ্ছিল সেটি ছিল তার শেষ সুখের সময়।

সে সময় দ্বিতীয়বারের মতো জীবনে সুযোগ পেয়ে তার মধ্যে এক ধরনের কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল। সে সময় তথ্যচিত্র তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন সানি।

ইচ্ছে ছিল লন্ডনের গৃহহীন মানুষদের নিয়ে তথ্যচিত্র বানাবেন। কিন্তু তখন তিনি কল্পনাও করেননি খুব শীঘ্রই তার জায়গা হবে তাদের কাতারে।

সানি সুন্দর জীবন পাবেন এমন আশা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন তখন। ভাবছিলেন যুক্তরাজ্যে নিরাপদ আশ্রয় মিলবে।

কিন্তু রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ার পর বিপদে পড়ে যান সানি। তখন তার সামনে দুটো পথ খোলা ছিল।

একটি হল সামরিক শাসকের অধীনে থাকা নাইজেরিয়ায় ফিরে যাওয়া যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে ফাঁসির দড়ি। অথবা আত্মগোপনে চলে যাওয়া।

এভাবেই শুরু হয়েছিল তার ২১ বছরের যাযাবর জীবন। সানি দ্রুতই অনুধাবন করলেন লন্ডনের রাস্তার চেয়ে বাসে চড়া অনেক আরামদায়ক এবং নিরাপদ।

লন্ডনের একজন ধর্মযাজিকা তাকে প্রথম একটি বাসে চড়ার মাসিক পাস কিনে দিয়েছিলেন। এরপর মাসের পর মাস তিনি এই সহায়তা চালিয়ে গেছেন।

মাঝে মাঝে সেই ধর্মযাজিকার পরিচিতরাও তাকে বাসের পাস কিনে দিতেন। দিনের বেলায় সানি গির্জায় স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতেন। মাঝে মাঝে দিনের বেলায় কাজ শেষ হয়ে গেলে চলে যেতেন লাইব্রেরিতে, বই আর খবরের কাগজ পড়ে সময় কাটাতেন।

রেস্টুরেন্টে খাবার চেয়ে পাননি এমন দিন খুব কমই ছিল। তবে রাত নটার মধ্যেই কোন একটা রাতের বাসে চেপে বসতেন। বেশ তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করে ফেললেন বিশ্রামের জন্য কোন রুটের বাস সবচাইতে ভালো। জেনে গেলেন রুট ২৫শে উঠলে সারারাত ভালো ঘুমিয়ে কাটানো যায়।

অনেক বাস চালক দয়াবসত বাসের ডিপোতে পৌঁছেও তাকে ঘুম থেকে উঠাতেন না। তার মতো আরও বেশ কয়েকজন গৃহহীন মানুষ নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে একইভাবে বাস ব্যবহার করেন। সানি তাদের ব্যাগ ওঠানামায় সহায়তা করতেন।

অন্য গৃহহীনদের মতো বড় সুটকেস বা বাক্স-পেঁটরার বদলে তিনি নিজে অবশ্য সবসময় হালকা ব্যাগ নিয়ে ভ্রমণ করেন। এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলোতে গৃহহীনদের যে একটি চিরচেনা ইমেজ রয়েছে সেটি থেকে তাকে আলাদা লাগতো।

অনেক গৃহহীন ব্যক্তি বাসে উঠে সিটে গা এলিয়ে বসতেন কিন্তু সানি অন্য যাত্রীদের যাতে অসুবিধা না হয় সে ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। ধীরে ধীরে বাসে কিভাবে ঘুমাতে হয় তার কায়দাকানুন শিখে যান তিনি।

কোথায় বসলে বেশি আরাম পাওয়া যাবে, বাসের দোতালায় বসার চেয়ে নিচের তলা বেশি সুবিধা সেসব বুঝে গেলেন। একবার দুজন লোক একজন নারীর চুলে আগুন দেয়ার চেষ্টা করছিল। তাদেরকে ধাওয়া দিয়ে বাস থেকে তাড়িয়েছিলেন সানি। কিন্তু সবই যে সুখকর তা নয়। হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে বাস থেমে যাওয়া, রাস্তার নিয়ন বাতি, রাতের বেলার মাতাল যাত্রী অথবা বেশি শব্দ করা বাসের ইঞ্জিন।

ভোর হলেই খিদে পেটে মোচড় দিয়ে উঠলে ম্যাকডোনাল্ডসে ঢুকে যেতেন। কিছু ভালো মনের কর্মীরা তাকে টয়লেট ব্যবহার করতে দিতেন বা দাড়ি কামাতে দিতেন। তিনি কখনো টাকার জন্য ভিক্ষা করেননি। মাঝে মাঝে হারিঙ্গে এলাকায় ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে এমন কোন ম্যাকডোনাল্ডস শাখায় ঢুকে যেতেন। মনমরা মানুষদের সংস্পর্শ তাকে পীড়া দিত।

আশ্রয়কেন্দ্রের চেঁচামেচি, গাদাগাদি করে ঘুমানো, সিগারেট, মদ ও মানুষের শরীরের গন্ধ তার ভাল লাগতো না। তাই তার মনে হল বাসের পরিবেশই বেশি আরামদায়ক। প্রতিদিন নিত্যনতুন মানুষের দিকে তাকিয়ে তাদের ভাষা ও উচ্চারণের বৈচিত্র্য, মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এগুলো সম্পর্কে শিখেছেন তিনি।

তবে শীতকালে সানির দৈনন্দিন জীবন কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল। গৃহহীনদের জন্য শহরের বিভিন্ন গির্জার পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতেন তিনি। কিন্তু সেখানে এমনকি মানুষের গলার স্বর বা শরীরের ভঙ্গি দেখে বিপদের মুহূর্ত আঁচ করতে পারেন। ২১ বছরে বাসে তিনি অনেক ধরনের মানুষ দেখেছেন।

বখে যাওয়া কিশোর, বড় কোন ম্যাচের পর মাতাল ফুটবল ফ্যান, অপরাধী চক্রের সদস্য এরকম নানা ধরনের মানুষ যখন একসাথে বাসে ওঠে তখন সেখানে সংঘর্ষ বাধার সম্ভাবনা তিনি বুঝে ফেলেন।

কিন্তু ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট গণভোটের পর অভিবাসীদের প্রতি বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণ বেড়ে গিয়েছিল। “নিজের দেশে ফিরে যাও”, এমন বাক্য তখন নিয়মিত শুনতে হতো। তবে এই কষ্টের জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারকে দোষ দিতেন না বরং দুর্দশার জন্য নিজের দেশের সরকারকেই দায়ী করেন তিনি।

এক পর্যায়ে প্যারিসের নটরডেম ক্যাথেড্রালের হয়ে কাজ করে এরকম একদল আইনজীবী তার সহায়তায় এগিয়ে আসে। ব্রিটেনে একটানা ২০ বছর বাস করার কারণে আইনগতভাবে তিনি সেখানে থেকে যাওয়ার উপযুক্ত সেই যুক্তি তুলে ধরে তারা তার জন্য ব্রিটেনে থাকার আবেদন করেন।

কিন্তু ২০ বছর বাসের রাত কাটানো গৃহহীন সানি সেটি প্রমাণ করার কোন উপযুক্ত কাগজপত্র ছিল না। অবৈধভাবে বসবাসের জন্য তাকে সবসময় কর্তৃপক্ষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে হয়েছে।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর তার আবেদনের জবাবে জানিয়েছিল, কোন ধরনের বিদ্যুৎ বিল, বাড়ি ভাড়ার কাগজ বা ব্যাংকের হিসেব তার নেই। এরকম কাগজপত্র তার দরকার হবে। সানি তার সবচেয়ে পছন্দের বাস চালককে একটি চিঠি দিতে অনুরোধ করেছিলেন।

লন্ডনের কয়েকটি গির্জা ব্রিটেনে তার বসবাসের ব্যাপারে কাগজপত্র দিয়ে সহায়তা করার চেষ্টা করে। লন্ডনে সানি’র বসবাসের ছবি সংগ্রহ করে সহায়তা করার চেষ্টা করেছিল তারা।

কিন্তু ইদানীং সানি নিজেই ছবি তুলছেন। সেগুলো অবশ্য মূলত রাতের বাসের খালি আসন। তথ্যচিত্র বানানোর যে প্রশিক্ষণ তিনি নিয়েছেন সেটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। তার মতো মানুষদের গল্প বলার জন্য।

২০১৭ সালে ৫৫ বছর বয়সে শেষ পর্যন্ত তাকে ব্রিটেনে থাকার বৈধতা দেয়া হয়। সেখানে কাজ করার অধিকার পান তিনি। সানি এখনো বাসে চড়েন। তবে এখনো নির্দিষ্ট গন্তব্যের যাত্রার অভ্যাস তার হয়নি। এখনো মাঝে মাঝে রাতের বাসে চেপে ঘুরতে থাকেন তিনি। তার বহুদিনের আশ্রয় বাকি জীবনের জন্য তার মনের গভীরে একটি জায়গা করে নিয়েছে।