রাশিয়াকে কেন ‘শিক্ষা’ দিতে চাইছেন ওবামা?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

সাইবার হামলা কিংবা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে রাশিয়া মার্কিন নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে; এই অভিযোগ  নতুন নয়। তবে শুক্রবার মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ সাইবার আক্রমণে রুশ সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ফের বিষয়টি নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মার্কিন রাজনৈতিক অঙ্গন। আগের মতোই নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ বা প্রভাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। ট্রাম্পের অন্তবর্তী দলের পক্ষ থেকে সিআইএকে ইঙ্গিত করে দাবি করা হয়েছে, সেই গোয়েন্দা সংস্থা এই অভিযোগ তুলছে যারা ইরাকে মানবধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ্যে দাবি করেছিল। এর বিপরীতে ডোমোক্র্যাটদের চাপে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা তার মেয়াদকালেই সিআইএ-এর তদন্তের পুরো প্রতিবেদন গভীরভাবে যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তার ঘনিষ্ঠজনরা মনে করছেন, ক্ষমতা ছাড়ার আগে রাশিয়াকে শিক্ষা দিতে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করবেন ওবামা।

 

তবে কেন ওবামা রাশিয়াকে শিক্ষা দিতে চাইছেন, এই প্রশ্নে ভিন্নমত রয়েছে বিশ্লেষকদের মধ্যে। কেউ বলছেন, তিনি চাপে পড়ে এটা করছেন। কেউ বলছেন, তিনি দেরিতে হলেও একটি ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেউবা আবার বলছেন, নিতান্তই রাজনৈতিক কারণে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজ প্রশাসনের ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছেন।

 

নির্বাচনি প্রচারণার সময় ওঠা অভিযোগ পুনরায় মার্কিন রাজনীতিতে আলোড়ন তোলে শুক্রবার। ওই দিন স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট জানায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে  ট্রাম্পকে জেতানোর জন্য রাশিয়া সাইবার হামলা চালিয়েছিল বলে দাবি করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ।

 

মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, রুশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জড়িত যেসব ব্যক্তি উইকিলিকসের হাতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্যদের হাজার হাজার নথি তুলে দিয়েছিলেন, তাদেরও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা শনাক্ত করতে পেরেছে। ওই কর্মকর্তাদের দাবি, যেসব ব্যক্তি ওই কথিত হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত, তারা নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারির সমালোচনা সামনে এনে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের জয়ের পথ সুগম করার কাজ করছিলেন।

 

এক জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘মার্কিন গোয়েন্দারা ধারণা করছে, এখানে রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল, এক প্রার্থীকে ঘায়েল করে অপরজনকে সমর্থন করা, ট্রাম্পের জয়ে সাহায্য করা।’

 

ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, গত সপ্তাহে এ সম্পর্কিত সিআইএ-র একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিশিষ্ট সিনেটরদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তখন ওই সিআইএ গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিনেটরদের এ সম্পর্কে অবহিত করেন।

 

একই দিন হোয়াইট হাউসের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী ইউনিটের পরিচালক লিসা মোনাকো ক্রিশ্চিয়ান জানিয়েছেন, রাশিয়ার সাইবার হামলার অভিযোগ পুনরায় খতিয়ে দেখার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছেন বারাক ওবামা। আর হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র এরিক শুলজ জানিয়েছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ওবামা বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। সেজন্য তিনি এর তদন্ত করতে বলেছেন।’ যদিও হোয়াইট হাউস মুখপাত্রের দাবি, এর মধ্য দিয়ে মার্কিন নির্বাচনের ফলাফলকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে না। কারণ আমেরিকা তাদের নির্বাচন পদ্ধতির স্বচ্ছতা এবং অখণ্ডতা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।

 

প্রশাসনিক নেতৃত্ব গ্রহণের অল্প কিছুদিন বাকি থাকতে সিআইএ-এর সমালোচনা ও রুশ সাইবার হামলার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।শুক্রবার ক্ষমতা হস্তান্তরের অন্তবর্তী টিমের পক্ষ থেকে ট্রাম্পকে রাশিয়া সাইবার হামলা চালিয়ে নির্বাচনে জয়ী হতে ও ফল প্রভাবিত করেছে যে অভিযোগ ওঠেছে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। স্বাক্ষরবিহীন এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই অভিযোগ যারা তুলছেন তারাই বলেছিলেন সাদ্দাম হোসেনের কাছে মানববিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। নির্বাচন শেষ হয়েছে অনেক দিন আগে। যা ছিলো ইতিহাসের অন্যতম বড় ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের ব্যবধানের জয়। এখন যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও মহান করে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

 

ডেমোক্র্যাট দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনি প্রচারের সময়ও অভিযোগ করা হয়েছিল, দলটির ন্যাশনাল কনভেনশন ও শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার ইমেইল হ্যাক করেছে রাশিয়ার হ্যাকাররা এবং তা উইকিলিকসের মাধ্যমে ফাঁস করা হয়েছে। নির্বাচিন প্রচারণার সময় হিলারির প্রচারণা টিমের চেয়ারম্যান জন পডেস্টার ইমেইলও ফাঁস হয়। পদত্যাগ করেন দলটির চেয়ারম্যান। অবশ্য টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারেও রুশ হ্যাকারদের জড়িত থাকার অভিযোগ খারিজ করেছিলেন ট্রাম্প। বলেছিলেন, ‘আমি এটা মনে করি না। আমি বিশ্বাস করি না তারা হস্তক্ষেপ করেছে।’ এ অভিযোগকে ডেমোক্র্যাটদের সংকীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। তবে মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকো জানাচ্ছে, বিভিন্ন খবরে জানা যাচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নির্বাচনে রুশ সাইবার প্রভাবের বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, যা ট্রাম্পকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। ওবামা দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার আগেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন চেয়েছেন। ফলে ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার আগ মুহূর্তেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের বিষয়টির বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশের আশা করা হচ্ছে।

 

তবে বিস্তারিত চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের কতটুকু জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। যদিও হোয়াইট হাউস মুখপাত্র জানিয়েছেন, যতটুকু সম্ভব প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেন, অবশ্যই ধারণা করতে পারেন এ ধরনের তদন্ত প্রতিবেদনে গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর ও রাষ্ট্রীয় গোপন বিষয় থাকতে পারে। তবে তিনি জানিয়েছেন, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বিশেষ করে কংগ্রেসকে অবহিত করা হবে।তিনি জানিয়েছেন, এর সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

 

মার্কিন নির্বাচনের ইতিহাসে সাইবার হামলার অভিযোগ নতুন নয়। ২০০৮ সালে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সিনেটর জন ম্যাককেইন ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ওবামা চীনা হ্যাকারদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন বলে মনে করেন মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ওই সময় চীনা হ্যাকাররা দুই প্রার্থীর পলিসি পেপার ও শীর্ষ উপদেষ্টাদের ইমেইল হ্যাক করেছিল। ২০১২ সালেও রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিট রমনির ব্যক্তিগত হটমেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছিল বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

 

চলতি বছরের অক্টোবরে ওবামা প্রশাসন মার্কিন নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে রাশিয়া সাইবার হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ তুলে। মার্কিন কর্মকর্তাদের দাবি ছিল, ডেমোক্র্যাটিক দলের ন্যাশনাল কমিটি, ডেমোক্রেটিক দলের কংগ্রেস প্রচারণা ও অপর রাজনৈতিক সংস্থায় সাইবার হামলা চালিয়েছে মস্কো নিয়ন্ত্রিত হ্যাকাররা। হ্যাক করা গোপন ও ব্যক্তিগত তথ্যগুলো উইকিলিকস ও অপর সন্দেহজনক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ফাঁস করা হয়। হিলারির প্রচারণা টিমের প্রধান জন পডেস্টা ও বেশ কয়েকজন ডেমোক্র্যাট কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ই-মেইল হ্যাক করারও অভিযোগ ওঠে।

 

মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজ জানায়, সাইবার হামলায় রাশিয়ার সম্পৃক্ততার বিষয়টি ট্রাম্প বার বার প্রত্যাখ্যান করায় ওবামা এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। ওবামা প্রশাসনের কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমটিকে জানিয়েছেন, ওবামা শঙ্কিত কারণ তিনি যদি কোনও উদ্যোগ না নেন তাহলে রাশিয়া বিনা বিচারে পার পেয়ে যাবে। এছাড়া ক্যাপিটাল হিলের দীর্ঘ একমাস ধরে চলে আসা চাপও ছিলো।

 

সেপ্টেম্বরে ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর ও সিনেট গোয়েন্দা কমিটির সদস্য ডিয়ানে ফেইনস্টেইন এক বিবৃতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে সাইবার হামলার মাধ্যম যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তোলেন। গত কয়েক মাস ধরেই যা নিয়ে ছিলো মার্কিন রাজনীতিতে উত্তেজনা। তবে নির্বাচনের ডামাঢোলে তা প্রচারের আলোয় আসেনি খুব একটা। গত সপ্তাহে ডেমোক্র্যাটিক দলের হাউস কমিটির শীর্ষ পদধারী হুইপ স্টেনি হয়ার ওবামার কাছে একটি চিঠি লিখলে তা পুনরায় আলোচনায় চলে আসে। চিঠিতে তিনি কংগ্রেসকে নির্বাচনে রাশিয়ার ভূমিকা সম্পর্কে জানানোর আহ্বান করবেন।

 

হোয়াইট হাউসের পুনঃতদন্তের বিষয়ে শুক্রবার কংগ্রেসে সংখ্যালঘিষ্ঠদের নেতার পক্ষে তার মুখপাত্র বলেছেন,  আমেরিকান জনগণের জানার অধিকার রয়েছে তাদের নির্বাচন নিয়ে কারা ছেলেখেলা করেছেন। নির্বাচনে হ্যাকিংয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আলাদা কমিশন গঠনের কথাও জানানো হয়েছে।

 

এছাড়া ওবামা প্রশাসনের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে রিপাবলিকান দলের কংগ্রেসের বিভিন্ন কমিটি ও সাব-কমিটির চেয়ারম্যানও সাইবার হামলা নিয়ে শুনানির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে সব রিপাবলিকানরা তা মনে করছেন না। অনেকে মনে করছেন, ওবামার হঠাৎ করে মস্কোর ভূমিকা নিয়ে সন্দিহান ওয়ে ওঠার পেছনে রাজনীতি রয়েছে। হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান ডেভিন নুনেস বলেনে, আগেও বহুবার বলেছি, গোয়েন্দারা পুতিনের পদক্ষেপ সম্পর্কে ধারণা করতেই ব্যর্থ হয়েছেন।

 

নুয়ানেসের মতে, রাশিয়ার সাইবার হামলায় হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটির আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।কারণ বহু বছর ধরেই নিবিড়ভাবে রাশিয়ার পদক্ষেপগুলো নজরদারি করছে তারা। ওবামা প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে ইন্টেলিজেন্স কমিটির পরামর্শ উপেক্ষা করে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনে মশগুল ছিলো। হঠাৎ করে নিশ্চই তাদের ভ্রম কাটেনি।

 

রাশিয়া বিশেষজ্ঞ রবার্ট আমস্টারডাম যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, পররাষ্ট্রনীতিতে নিদারুণ ব্যর্থ ওবামা প্রশাসন নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে রাশিয়ার দিকে আঙুল তুলছে। কারণ ওবামা প্রশাসনের ব্যর্থ নীতির কারণেই ট্রাম্পের উত্থান ঘটেছে।

 

কন্ডোলিসা রাইসের অধীনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করা এলিয়ট কোহেন মনে করেন, ওবামার পদক্ষেপটি অবশ্যই ভালো। তবে তা অনেক পরে নেওয়া হলো।

 

অ্যামেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল প্লেটকা বলেন, এ পদক্ষেপটা চূড়ান্ত অর্থে রাজনৈতিক। রাশিয়া নতুন করে কোনও কিছুতে হস্তক্ষেপ করেনি। এটা তারা করেই আসছে। ইউরোপ ও সিরিয়ায় রাশিয়া যা করছে সেক্ষেত্রে ওবামার সিদ্ধান্ত ভিন্ন।পুতিন ও লাভরভের কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে তারা (ওবামা প্রশাসন) এখন হতাশ।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন