রাশিয়ায় ক্ষমতার ২০ বছর যেভাবে কেটেছে ভ্লাদিমির পুতিনের

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক

ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর ক্ষমতায় থাকার ২০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছেন।

গত ২০ বছরে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এ সময়ের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক সংকট যেমন তৈরি হয়েছে তেমনি বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় আসর অর্থাৎ বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছে রাশিয়া।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি’র একজন এজেন্ট ছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন।

১৯৯৯ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর তিনি যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হলেন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিল ক্লিনটন।

গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের তিন প্রেসিডেন্ট এবং ব্রিটেনের পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করেছেন।

বৈশ্বিক সংঘাত, দেশের অভ্যন্তরে নানা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে খেলাধুলার আসর আয়োজন এবং নিজের প্রচারণার জন্য নানা ছবি – এ সবকিছুই আছে মি: পুতিনের এই ২০ বছরে।

তাঁর ক্ষমতার ২০ বছরে সেসব দিকে দৃষ্টি দিয়েছে বিবিসি।

ইয়েলেতসিন ও পুতিন করমর্দন করছেন
১৯৯৯ সালের অগাস্ট মাসে ভ্লাদিমির পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। বরিস ইয়েলেতসিনের বিদায়ের পর ৩১ শে ডিসেম্বর মি: পুতিন প্রেসিডেন্ট হন।

কেজিবি’র সাবেক এ কর্মকর্তা ১৯৯৯ সালে যখন ক্ষমতাসীন হলেন তখন দ্বিতীয়বারের মতো চেচনিয়া যুদ্ধ শুরু করে রাশিয়া। কিছু এপার্টমেন্টে বোমা হামলার জবাবে সে অভিযান শুরু করে রাশিয়া।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে মি: পুতিনের সূচনা হয়েছিল রাশিয়ার অস্থির দক্ষিণাঞ্চলে সংঘাতের মধ্য দিয়ে।

চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনি অবরোধ করে রাখে রাশিয়ার সৈন্যরা।

২০০৩ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে গ্রোজনিকে বিশ্বের সবচেয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

পুতিন
২০০০ সালের মার্চ মাসে মি: পুতিন চেচনিয়া সফর করেন।

এরপর কয়েক বছর ধরে জঙ্গি হামলায় আক্রান্ত হয় রাশিয়া। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ২০০৪ সালে বেসলান স্কুলে হামলা, যেখানে ৩৩০ জন নিহত হয়। এদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল শিশু।

২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পুতিন চেচনিয়াতে যুদ্ধ শেষ করেননি।

২০০০ সালের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো সে পদে আসীন হন। এর কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি ইমেজ সংকটে পড়েন।

নিরবতা পালন করছেন পুতিন
২০০৪ সালে বেসলাস স্কুলে হামলায় নিহতদের প্রতি শোক করতে রাশিয়ার মন্ত্রীসভা এক মিনিট নিরবতা পালন করে।

কার্স্ক সাবমেরিন বিপর্যয়ে ১১৮ জন নাবিক মারা যায়।

২০০০ সালের অগাস্ট মাসে যখন কার্স্ক সাবমেরিন বিপর্যয় ঘটে তখন নিহত নাবিকদের পরিবারকে বিষয়টি অবহিত করতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগে।

তখন মি: পুতিন তখন অবকাশ যাপনে কৃষ্ণ সাগরে ছিলেন। কিন্তু সাবমেরিন বিপর্যয়ের পর প্রথমদিকে তিনি অবকাশ যাপন থেকে ফিরে আসেননি।

কার্স্ক সাবমেরিন কমান্ডারের পরিবারের সাথে দেখা করেন মি: পুতিন।
কার্স্ক সাবমেরিন কমান্ডারের পরিবারের সাথে দেখা করেন মি: পুতিন।

ক্ষমতার প্রথম দশকে মি: পুতিনের সাথে পশ্চিমা নেতাদের সম্পর্ক ভালোই ছিল। যদিও তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতির সমালোচক ছিলেন।

২০০৬ সালে রাশিয়া প্রথমবারের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট ‘জি এইট’ সম্মেলনের আয়োজন করে। এর মাধ্যমে সে জোটে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তিও ঘটে।

করমর্দন করছেন জর্জ বুশ এবং পুতিন
২০০১ সালে ভ্লাদিমির পুতিনকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ।

রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী মি: পুতিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরপর তিন মেয়াদে থাকতে পারতেন না। সেজন্য ২০০৮ সালে তিনি চার বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন।

সে সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন দিমিত্রি মেদভেদেভ। কিন্তু অনেকে মনে করতেন, মি: মেদভেদেভ ছিলেন মি: পুতিনের হাতের পুতুল।

সিলভিও বার্লোসকুনি ও পুতিন
২০০৩ সালে ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লোসকুনি রাশিয়া সফর করেন। সে সফরে ইরাক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
রানি এলিজাবেথ ও পুতিন
ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ ২০০৩ সালে মি: পুতিনকে ব্রিটেনে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানান। ১৮৭৪ সালের পর সেটাই ছিল রাশিয়ার কোন নেতার ব্রিটেন সফর।
২০০৬ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত জি এইট সামিটে
২০০৬ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত জি এইট সামিটে

জর্জিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সাউথ ওশেটিয়া অঞ্চলের কর্তৃত্ব ফিরে পাবার জন্য ২০০৮ সালে জর্জিয়া যখন সেখানে সৈন্য পাঠায়, তখন রাশিয়া জর্জিয়ার ভেতরে আক্রমণ করে।

স্বল্প সময়ের যুদ্ধ ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য মি: পুতিন সম্পর্কে একটি সতর্কবার্তা। ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন পূর্ব ইউক্রেন আক্রমণ করে তখন পশ্চিমা নেতাদের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে।

ইউক্রেন থেকে ক্রাইমিয়া দখল করে নেবার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উপর অবরোধ আরোপ করে। এছাড়া শিল্পোন্নত দেশগুলোর সংগঠন ‘জি এইট’ থেকে রাশিয়ার সদস্যপদ স্থগিত করা হয়।

একজন আহতকে দেখছেন মি: পুতিন
জর্জিয়ার সাথে যুদ্ধ শুরু হলে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আহতদের দেখতে যান মি: পুতিন।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হবার চার বছর পরে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে রক্ষার জন্য রাশিয়া সে যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে।

তখন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ প্রায় পতনের মুখে চলে গিয়েছিলেন। সিরিয়াতে রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান এবং সরঞ্জাম পাঠানোর কারণে সেখানকার ভারসাম্য বদলে যায়।

বাশার আল আসাদ ও পুতিন
মি: পুতিন যখন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সমর্থন দেয়া শুরু করেন, তখন সিরিয়ার যুদ্ধের পরিস্থিতি বদলে যায়।

২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভ করার পর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বলে যে, দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছে।

২০১৮ সালে রাশিয়ার সাবেক সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা সার্গেই স্ক্রিপালকে ব্রিটেনের মাটিতে বিষ প্রয়োগে হত্যার জন্য রাশিয়াকে অভিযুক্ত করে ব্রিটেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পুতিন করমর্দন করছেন।
মার্কিন গোয়েন্দারা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছে।
করমর্দন করছেন টেরিজা মে এবং পুতিন
সার্গেই স্ক্রিপালকে বিষ প্রয়োগে হত্যার পর ব্রিটেনের তখনকার প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে’র সাথে সম্পর্ক শীতল হয়।
পুতিন
২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া দখল করার পর দেশের ভেতরে মি: পুতিনের জনসমর্থন বাড়ে।
পুতিনের সাথে অনেকে সেলফি তুলছেন।
২০১৯ সালের অগাস্ট মাসে মি: পুতিন ক্রাইমিয়ায় মোটর সাইকেল র‍্যালিতে অংশ নেন। এটিকে সার্বভৈৗমত্বের লংঘন হিসেবে বর্ণনা করেছে ইউক্রেন।
আলোচনার টেবিলে পুতিন
ইউক্রেন সংঘাত শুরুর পাঁচ বছর পর এ মাসে আলোচনা শুরু হয়।

ক্ষমতায় থাকার পুরো সময় জুড়ে মি: পুতিন তাঁর নিজের এবং দেশের ইমেজ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

নিজের কিছু ছবি দিয়ে প্রচারণার মাধ্যমে মি: পুতিন নিজেকে একজন শক্তিমান ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন।

পুতিন
২০০৭ সালে মঙ্গোলিয়ার সীমান্তে স্নাইপার হাতে হাঁটছেন ভ্লাদিমির পুতিন।
পুতিন
২০১৩ সালে পোষা কুকুকদের নিয়ে তুষাড়ের উপর খেলছেন মি: পুতিন।
আইস হকি খেলছেন মি: পুতিন
খেলাধুলায় নিজের পারদর্শিতা দেখানোর চেষ্টাও করেছেন মি: পুতিন। প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় আইস হকিতে অংশ নিয়েছেন।

২০১৪ সালে শীতকালীন অলিম্পিক এবং ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের মাধ্যমে মি: পুতিন ক্রীড়াঙ্গনে রাশিয়ার ভালো অবস্থান তুলে ধরতে চেয়েছেন।

সোচিতে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিক ছিল সফল। কিন্তু ডোপ কেলেঙ্কারির জের এখনো চলছে।

ফিফা প্রেসিডেন্টের সাথে মি: পুতিন
২০১৮ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট পুতিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

গত সপ্তাহে ওয়ার্ল্ড অ্যান্টি-ডোপিং এজেন্সি বা ওয়াডা রাশিয়াকে চার বছরের জন্য খেলাধুলার বড় আসরগুলোতে নিষিদ্ধ করেছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ডোপিং এর অভিযোগ ওঠে ২০১৫ সালে।

সে বছরের নভেম্বরে রাশিয়ার অ্যান্টি ডোপিং সংস্থা ‘রুসাডা’ মাদক বন্ধে সহযোগিতা করছে না বলে ঘোষণা করে ওয়াডা।

সংস্থার এক রিপোর্টে তখন বলা হয়েছিল, রাশিয়ায় সরকারি মদদেই ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাথলেটিক্সে ব্যাপকভাবে মাদক ব্যবহৃত হচ্ছে।

এরপর ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চার বছর ধরে ডোপিং কর্মসূচি চলেছে যাতে করে তাদের প্রতিযোগীরা গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন অলিম্পিকসে অংশগ্রহণ করতে পারে।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তারা ল্যাবরেটরি পরীক্ষার যেসব তথ্য হস্তান্তর করেছিল, তাতে কারসাজি করা হয় বলে অভিযোগ করছে ওয়াডা।

তবে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনে রাশিয়া ছিল সফল।

ডোপিং কেলেঙ্কারির জন্য ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকস এবং ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলে রাশিয়া অংশ নিতে পারবে না।