রামেক হাসপাতাল: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সঙ্কটে কার্ডিওলোজি-২ ইউনিটে ব্যাহত চিকিৎসাসেবা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলোজি বিভাগের শয্যা সংখ্যা মোট ৫৬টি। কিন্তু এখানে প্রতিদিন দুটি ইউনিট মিলে গড়ে রোগী ভর্তি থাকেন প্রায় ১৪০ জন। অতিরিক্ত রোগীদের চাপ সামলাতে ও উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রায় তিন মাস আগে দুটি ইউনিট করা হয় এই বিভাগটিতে। ২০০৫ সালে রামেক হাসপাতালে ক্যাথল্যাব কার্যক্রমের মতো উন্নত চিকিৎসাসেবা চালু হওয়ার পরে কার্ডিলোজি বিভাগের এক নম্বর ইউনিটে এটি এখনো চালু আছে। কিন্তু দুই নম্বর ইউনিটে একটিও এই পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ ও উন্নত চিকিৎসাসেবার দেওয়া সম্ভব হয়নি এতোদিনে। এ নিয়ে রোগীদের মাঝে যেমন বাড়ছে ভোগান্তি তেমনি উন্নত চিকিৎসাসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি দুই নম্বর ইউনিট থেকে ক্যাথল্যাব চিকিৎসার আওতাভূক্ত রোগীদের ঢাকা অথবা বাইরের দেশে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এতে করে রোগীদের বাড়তি অর্থ যেমন ব্যয় হচ্ছে, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে জীবন।

রামেক হাসপাতাল সূত্র মতে, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর এ হাসপাতালের কার্ডিলোজি বিভাগকে দুটি ইউনিটে ভাগ করে দেওয়া হয়। কার্ডিওলোজি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক রইচ উদ্দিনকে এক নম্বর ইউনিটের প্রধান এবং ওপর সহযোগী অধ্যাপক আইয়ুব আলীকে দুই নম্বর ইউনিটের প্রধান করে দুটি ইউনিট গঠন করা হয়। এর আগে একটি ইউনিটেই সার্বিক কার্যক্রম চালানো হতো। দুটি ইউনিটে ভাগ করার পরে এক নম্বর ইউনিটে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রোগী ভর্তি করা হয়েছে ৯৩৪ জন। অন্যদিকে দুই নম্বর ইউনিটে রোগী ভর্তি করা হয়েছে ৮১৮ জন। অন্যদিকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত এক নম্বর ইউনিটে ক্যাথল্যাব পদ্ধতির মতো জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ১০৬ জন রোগীর। সেখানে দুই নম্বর ইউনিটে একজন রোগীকেও এই পদ্ধতির চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়নি। এই ওয়ার্ড থেকে ক্যাথল্যাব পদ্ধতির চিকিৎসাপ্রাপ্ত রোগীদের ঢাকায় অথবা ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে রোগীদের ছুটি দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে এক নম্বর ইউনিটে হার্টের এনজিওগ্রাম ও ব্লক অপসারণ করাও হয়েছে অন্তত দেড়শ রোগীর। কিন্তু সেক্ষেত্রে একটিও রোগীর এই ধরনের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়নি।

রামেক হাসপাতালের একজন কার্ডিওলোজি বিভাগ সূত্র মতে, যেসব রোগীর হার্টের গতি মারাত্মকভাবে নেমে আসে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায় সেসব রোগীদের সাধারণত ক্যাথল্যাব পদ্ধতির চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এই পদ্ধতির চিকিৎসাসেবার মধ্যে রয়েছে করোনারি এনজিও গ্রাম (সিএজি), পারসুটেনিয়াস ট্রান্সলুমিনাল করোনারি এনজিওপ্লাস্টি (পিটিসিএ), টেম্পোরারি পেস মেকার টিপিএম), পারমানেন্ট পেস মেকার (পিপিএম) ও পিটিএমসি পদ্ধতির মতো অতি সুক্ষ ও অতিসাবধানতা মূলক চিকিৎসাসেবাগুলোর প্রয়োজন হয়। এর বাইরেও হার্টের আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও শেষ ধাপের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। তবে সেগুলোর চিকিৎসার জন্য রাজশাহীতে মেশিন না থাকায় তা সম্ভব হয় না। কিন্তু ক্যাথল্যাব পদ্ধতির চিকিৎসাগুলো কার্ডিওলোজি বিভাগের একটি ইউনিটে না হওয়ায় চরম ভোগান্তি ও রোগীদের ঝূঁকির মধ্যে পড়তে হচ্ছে বলে দাবি করেছেন চিকিৎসক ও অভিভাবকরাও।

রাজশাহী নগরীর দরিখরবোনা এলাকার ফয়সাল হোসেন নামের একজন অভিভাবক  অভিযোগ করে জানান, সম্প্রতি তাঁর মায়ের হার্টের সমস্যা দেখা দিলে তাঁকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলোজি বিভাগের দুই নম্বর ইউনিটে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পরে সুরাইয়া খানমকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে হার্টে পেশ মেকার বসানোর জন্য নির্দেশনা দিয়ে ছুটি দেওয়া হয়। এতে চরম বিপাকে পড়েন সুরাইয়া খানমের পরিবার।

ফয়সাল হোসেন বলেন, ‘দুই নম্বর ইউনিট থেকে মাকে যখন ছুটি দেওয়া হয়, তখন তাঁর অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। এই অবস্থায় আমরা জানতে পারি এক নম্বর ইউনিটেই এই পেশমেকার বসানো হয়। এরপর আমরা ছুটে যায় হাসপাতালের পরিচালকের কাছে। পরিচালকের নির্দেশে পরে আবার এক নম্বর ইউনিটে ভর্তি করে মায়ের হার্টের পেশমেকার বসানো হয়। এখন আমার মা অনেকটায় সুস্থ। কিন্তু ওই অবস্থায় ঢাকায় নিয়ে গেলে আমাদের যেমন বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হতো, তেমনি মায়ের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে পড়তো।’

একই অভিযোগ করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা রাশেদুল। তিনি বলেন, আমার বাবারও হার্টের সমস্যা দেখা দেয়ায় দুই নম্বর ইউনিট থেকে ঢাকা অথবা দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। শেষে এক নম্বর ইউনিটে আবারো ভর্তি করে পারমানেন্ট পেসমেকার বসানো হয়। এখন তিনি অনেকটাই সুস্থ আছেন। অথচ ওই অবস্থায় রোগীকে ঢাকায় বা দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো না আমাদের।’

রাশেদুল বলেন, ‘একই হাসপাতালের একই ওয়ার্ডের একটি ইউনিটে এই ধরনের জটিল রোগের চিকিৎসা হচ্ছে। অথচ আরেকটি ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা এই চিকিৎসাসেবা দিতে দক্ষ নয় বা পারেন না বলে রোগীদের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এটি চিকিৎসাসেবার নামে রোগীদের হয়রানি ও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ঠেলে দেওয়াও হচ্ছে। এই ধরনের জটিল রোগীদের প্রয়োজনে একটি ইউনিটেই রাখা উচিত বলেও মন্তব্য করেন রাশেদুল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের কার্ডিওলোজি বিভাগের দুই নম্বর ইউনিটের প্রধান আইয়ুব আলী এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে এক নম্বর ওয়ার্ডের ইউনিট প্রধান ও বিভাগীয় প্রধান রইচ উদ্দিন বলেন, ‘ক্যাথল্যাব পদ্ধতির চিকিৎসা একটি জটিল ও খুবই সাবধানতামূলক চিকিৎসা। এ পদ্ধতির চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের হাতে-কলমে অভিজ্ঞ হতে হয়। কিন্তু দুই নম্বর ইউনিটে সেই মাণের চিকিৎসক না থাকায় এ পদ্ধতির চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। এতে রোগীদের ভোগান্তি হচ্ছে। তবে বিষয়টি সমাধানের পথও খোঁজা হচ্ছে।’

অন্যদিকে হাসপাতালের উপ-পরিচালক সাইফুল ফেরদৌস বলেন, ‘কার্ডিলোজি বিভাগের দুই নম্বর ওয়ার্ডে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে ক্যাথল্যাব পদ্ধতির চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাচ্ছে না। এতে রোগীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আমরা এটি সমাধান করবো দ্রুত।’

জানা গেছে, রামেক হাসপাতালের কাডিওলোজি বিভাগের দুটি ইউনিট মিলে মোট চিকিৎসক রয়েছেন ১২ জন। এর মধ্যে নতুন চিকিৎসক রয়েছেন তিনজন। যারা এখনো শিখছেন। আর ক্যাথল্যাব পদ্ধতির চিকিৎসার জন্য শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন বিভাগীয় প্রধান রইচ উদ্দিন।