রামেক হাসপাতালের নার্সিং বিভাগ অনিয়মের অভায়রণ্য, পদে পদে অপদস্থ নার্সরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নার্সিং বিভাগ যেন অনিয়মের অভায়রণ্যে পরিণত হয়েছে। এ বিভাগের প্রধান হলেন সেবা তত্বাবধায়ক আনোয়ারা খাতুন। কিন্তু সব সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন উপসেবা তত্বাবধায়ক সুফিয়া খাতুন। সেবা তত্বাবধায়কের প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন সুফিয়া খাতুন। ফলে নার্সরা নিগৃহীত বা নানাভাবে অপদস্থ হলেও কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পান না। এমনকি তাদের হাতেই কখনো কখনো নিগৃহীত হয়েছেন নার্সরা। এতে চরম ক্ষোভ নার্সদের মাঝে।

সম্প্রতি রামেক হাসপাতালে পর পর দুইদিন এক চিকিৎসকের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হন দায়িত্বরত একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স। এই ধরনের ঘটনার পর নিয়ম অনুযায়ী আনোয়ারা খাতুন ও সুফিয়া খাতুন বিষয়টি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরকে অবহিত করবেন। কিন্তু তাঁরা সেটি করেননি। উল্টো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পরবর্তিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে অধিদপ্তর তোপেরমুখে পড়েন ওই দুই কর্মকর্তা।

এছাড়া আগামী ২ ফেব্রুয়ারি তাদের ঢাকায় তলব করা হয়েছে। যৌন হয়রানির বিষয়টি অধিদপ্তরকে না জানানোর কারণে নার্সদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা এখন এ দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। দুর্ব্যবহার থেকে শুরু করে জানাচ্ছেন তাদের অনিয়ম আর দুর্নীতির কথাও।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৬ জানুয়ারি একজন সিনিয়র স্টাফ নার্সকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন উপসেবা তত্বাবধায়ক সুফিয়া খাতুন। ওই নার্স সেদিন ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সুফিয়া খাতুন পরিদর্শনে গিয়ে ওয়ার্ড নোংরা দেখতে পান। এ সময় তিনি ওয়ার্ড ইনচার্জকে গালিগালাজ করেন। ওয়ার্ড ইনচার্জ তাকে জানান, ওয়ার্ডে কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই। এরপর সুফিয়া নার্সদের ডিউটি রুম পরিদর্শন করেন। সেখানেও ময়লা দেখে তিনি বাইরে এসে রোগী, রোগীর স্বজন এবং অন্যান্য সহকর্মীদের সামনে দায়িত্বরত সিনিয়র স্টাফ নার্সের কান ধরে তাঁকে ডিউটি রুমে নিয়ে যান এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন।

গত ১১ মে উপসেবা তত্বাবধায়ক ১০ নম্বর ওয়ার্ডের আরেক সিনিয়র স্টাফ নার্সের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন। একটি কাজের জন্য ওই নার্স তার ওয়ার্ড ইনচার্জের সঙ্গে সেদিন সুফিয়া খাতুনের দপ্তরে গিয়েছিলেন। কিন্তু ইনচার্জের সঙ্গে যাওয়ার কারণে সুফিয়া খাতুন জুনিয়র সহকর্মীদের সামনেই ওই নার্সকে প্রচণ্ড বকাবকি করেন। একপর্যায়ে তাঁকে রুম থেকে বের করে দেওয়া হয়। ২৫ বছরের চাকরিজীবনে এমন অপমান আর কখনো হননি বলে ওই নার্স দাবি করেছেন।

যেসব নার্সের শিশু বুকের দুধ পান করে তাদের করোনা ওয়ার্ডে ডিউটি না দেয়ার জন্য সরকারি নির্দেশনা আছে। কিন্তু নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে ল্যাক্টেটিং মাদার নার্সদের করোনার ওয়ার্ডে জোর করে ডিউটি দিয়েছেন উপসেবা তত্বাবধায়ক। এ নিয়ে নার্সদের মাঝে চরম অসন্তোষ রয়েছে। গত এপ্রিলে ১১ মাসের বাচ্চা থাকলেও এক নার্সকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল করোনা ওয়ার্ডে। ওই নার্স সেবা তত্বাবধায়ক আনোয়ারা খাতুনের কাছে গিয়ে তাঁর সমস্যার কথা জানান। তখন আনোয়ারা খাতুন উপসেবা তত্বাবধায়ক সুফিয়ার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। সুফিয়া তখন ওই নার্সের সঙ্গে তখন চরম দুর্ব্যবহার করেন এবং বলেন, ‘বাচ্চা দেখার দায়িত্ব নার্সিং সুপার অফিসের নয়। বাধ্য হয়ে ওই নার্সকে ২৮ নম্বর ওয়ার্ডেই দায়িত্ব পালন করতে হয়।’

গত ৯ মে রামেক হাসপাতাল থেকে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত খ্রীষ্টিয়ান মিশন হাসপাতালে ডিউটি দেওয়া হয়। তখন এই নার্সের বাচ্চার বয়স ছিল ২০ মাস। শিশুটি বুকের দুধ পান করত। শিশুটির তখন একটি অস্ত্রোপচারও করতে হয়েছিল। প্রতিদিন দুইবার বাড়িতেই তার ড্রেসিং এবং ওয়াশ করতে হতো। সরকারি নির্দেশনার বিষয়টি নিয়ে ওই নার্সও সেবা তত্বাবধায়কের কাছে যান। কিন্তু তিনি এই নার্সকেও করোনা হাসপাতালেই দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করান।

অন্যদিকে প্রশাসনিক কাজে সেবা তত্বাবধায়ক নিষ্ক্রিয় থাকলেও নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির সময় উপসেবা তত্বাবধায়কের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করেন বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, করোনাকালে নার্সদের হোস্টেলে ১৪ দিন করে কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা ছিল। প্রত্যেক নার্সের জন্য বালতি, সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, টাওয়েল, মগসহ সকল প্রকার ব্যবহার্য জিনিসপত্র আলাদা আলাদা সরবরাহেরও নির্দেশনা ছিল। কিন্তু নার্সদের অভিযোগ, ছোট ছোট এ সকল জিনিসপত্র প্রত্যেক নার্সকে আলাদা সরবরাহ করা হয়নি। বালতি-মগের মতো যেসব সামগ্রী একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করতে পারবেন সেসব জিনিস পর্যাপ্ত কেনা হয়নি। সেই টাকা আত্মসাত করা হয়েছে।

অভিযোগে আরও জানা গেছে, নার্সরা হোস্টেলে না থেকে বাড়ি থেকে করোনা ওয়ার্ডে ডিউটি করলে এক হাজার টাকা করে সম্মানী পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনদিন করোনা ওয়ার্ডে রোগী না থাকলে সেইদিনের জন্য নার্সদের সম্মানী দেওয়া হয়নি।
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের নির্দেশনা রয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কোনো নার্সের বদলি, পদোন্নতি বা অন্য কোনো দায়িত্বে পদায়ন করতে পারবে না। কিন্তু আনোয়ারা খাতুন ও সুফিয়া খাতুন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে তাদের পছন্দ অনুযায়ী ১০ জনকে তাঁদের অফিসে নার্সিং সুপারভাইজার হিসেবে পদায়ন করিয়ে নিয়েছেন। গত বছরের ২৬ আগস্ট হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) এক অফিস আদেশে ১০ জন নার্সকে সুপারভাইজার হিসেবে পদায়ন করেছেন।

তবে হাসপাতালের সেবা তত্বাবধায়ক আনোয়ারা খাতুন অনিয়মের অভিযোগগুলো অস্বীকার করে বলেন, ‘পদে তো আমিই বড়। আমার চেয়ে তো তিনি বড় নন। তবে আমি তার সহযোগিতা নিই। তাঁকে দিয়ে সব কাজ করানোর বিষয়টি সঠিক নয়। কাউকে অপদস্থ করার বিষয়টিও সঠিক নয়।’

নার্সদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার প্রমঙ্গে উপসেবা তত্বাবধায়ক সুফিয়া খাতুন বলেন, ‘এসব মিথ্যা কথা। আমি কারও সাথে দুর্ব্যবহার করি না।’ সুফিয়া খাতুন ফোনে এর চেয়ে বেশি কথা বলতে চাননি।’