রাবিতে ভিন্নমত পেলেই ছাত্রলীগের মারধর, ৩ বছরে নির্যাতনের শিকার ৪৯ শিক্ষার্থী

নিজস্ব প্রতিবেদক:
ভিন্নমতের শিক্ষার্থী পেলেই তুলে নিয়ে যাওয়া, টাকা-ফোন ছিনিয়ে নেওয়া এবং উপুর্যপুরী মারধর করে শিবির-ছাত্রদল কিংবা মাদক সংশ্লিষ্ট তকমা দিয়ে পুলিশে দেওয়া। এ রকম ঘটনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) কম নয়। গত তিন বছরে ৪৯ জন শিক্ষার্থী এভাবে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতিতদের দোষ একটাই, তারা ভিন্নমতের নতুবা সরকারের সমালোচনাকারী।

বিরোধী দলের কিংবা মতের কাউকে পেলেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন রাবি শাখা ছাত্রলীগ। এরপর মারধরের বিষয়টি ঢাকতে লাগানো হয় শিবির-ছাত্রদল তকমা। তবে এ রকম নির্যাতন বাক স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরা।

শিক্ষকেরা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রও একটি চেতনা। ভিন্নমতকে সহ্য করা গণতন্ত্রেরই একটি অংশ। ভিন্নমত যখন রাষ্ট্র বিরোধী কিংবা বিভ্রান্তি ছড়াবে সেক্ষেত্রে আইন ব্যবস্থা নেবে। রাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. মো. সুলতান মাহমুদ সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষার্থী নির্যাতনকে বৈধতা দিতেই ভুক্তভোগীদের শিবির-ছাত্রদল তকমা লাগানো হয়। তবে যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক যারা তারা কখনোই এ কাজ করতে পারে না। কিছু নেতাকর্মী যারা আদর্শের রাজনীতি করে না তারাই এসব করে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত তিন বছরে শুধু ছাত্রদল-শিবির সন্দেহেই মারধরের শিকার হয়েছে ৪০ শিক্ষার্থী। এ ছাড়াও কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন, ছাত্রলীগের নিষেধাজ্ঞা না শোনায় ছয়জন ও প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করায় আরো দুজন নির্যাতিত হন। অনেককেই আবার দেওয়া হয় পুলিশে। অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় অনেককেই ছেড়ে দেয় পুলিশ।

হলের অভ্যন্তরে এবং ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে মারধরের এসব ঘটনা ঘটলেও বরাবরের মতোই নিশ্চুপ প্রশাসন। কোনো শিক্ষার্থীকে মারধর করা হচ্ছে এমন খবর পেলেও প্রশাসন ঘটনাস্থলে পৌঁছান খুব দেরিতে। নাম গোপন রাখার শর্তে এক অধ্যাপক বলেন সিল্কসিটি নিউজকে , ‘যখন যেই দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের অনুসারীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পেয়ে থাকে। তাই তারা সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের বিরোধিতা করে না।’

চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি রাবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্তের নেতৃৃত্বে কয়েক নেতাকর্মী তিন শিক্ষার্থীকে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী হলে জিম্মি করে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। পরে তাদের মারধর করে মাদককারবারি ও ছাত্রদল আখ্যা দিয়ে পুলিশে দেওয়া হয়। ১৮ জানুয়ারি মাজহারুল ইসলাম নামের এক ছাত্রদল কর্মীকে মারধর করে ছাত্রলীগ। গত বছরের ১৮ অক্টোবর ১৪ জন এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি নয়জনকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে এবং এর আগের বছরের আগস্টে সোহ্রাওয়ার্দী হল থেকে ১৩ শিক্ষার্থীকে রাতভর পিটিয়ে শিবির আখ্যা দিয়ে পুলিশে দেওয়া হয়। গত বছরের ১ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে বণিজ্যিক সিনেমার প্রদর্শনীর প্রতিবাদ করায় ছয়জন এবং ২ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা তরিকুল ইসলাম মারধরের শিকার হন। হাতুড়ি, লাঠি, বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে তরিকুলের কোমর ও পায়ের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়। সেই তরিকুল আজও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হননি। এ ছাড়াও ১৩ নভেম্বর ও ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট করায় দুই শিক্ষার্থী নির্যাতিত হন। মারধরের পর ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ফোন ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের এই শাখার বিরুদ্ধে।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের এই শাখার সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, আমরা যাদেরকে পুলিশে দেই তাদের অনেকের নামেই নাশকতা মামলা রয়েছে। একটা সময় শিবির আমাদের নেতাকর্মীদের অনেক ক্ষতি করেছে। অনেকের হাত-পা কেটে নিয়েছে। আমরা ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ ও শিবিরমুক্ত রাখতে চাই। তাই সন্দেহ হলে আমরা তাদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। আর শিবির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেলেই কেবল পুলিশে দেই।

এদিকে, মারধরকারীরা ক্যাম্পাসেই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা নির্বিঘ্নে এ ধরনের কাজ করছে। অপরাধী যে দলেরই হোক ব্যবস্থা নিলে অপরাধ কমত বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

তবে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ না করায় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয় না বলে জানান প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান। তিনি সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ‘ভুক্তভোগীরা আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করে না। তারা অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’

স/অ