রাতারাতি স্থাপনা গেড়ে বিরোধপূর্ণ জমি দখলে দলিল লেখক সমিতির

কাজী কামাল হোসেন, নওগাঁ:
নওগাঁর বদলগাছীতে বিরোধপূর্ণ সেই জমিতে স্থাপনা ও সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দখলের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় দলিল লেখক সমিতির বিরুদ্ধে। গত রোববার রাতে দলিল লেখক সমিতির লোকজন ওই জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করে দখলে নেয়। সোমবার সকাল থেকে ওই স্থানে দলিল লেখার কাজ শুরু করেছেন সমিতির লোকজন।
এর আগে গত ২৪ ডিসেম্বর রাতে দলিল লেখকেরা ওই জমিতে থাকা ২৭টি আম গাছ কেটে জমিটি জবর-দখলের চেষ্টা করে। এ নিয়ে গত ২৬ ডিসেম্বর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়।

ওই ঘটনার পরদিন জমির মালিকের ছেলে জাহাঙ্গীর সেলিম বাদি হয়ে বদলগাছী থানায় একটি এজাহার দাখিল করেন। কিন্তু পুলিশ এজাহারটি এখনও মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি।

সোমবার দুপুরে সরেজমিনেগিয়ে দেখা যায়, বদলগাছী টিএন্ডটি অফিসের পাশে বিরোধপূর্ণ ওই জমির পশ্চিম পাশে টিন দিয়ে ঘর তৈরি করে সেখানে দলিল লেখার কাজ করছেন দলিল লেখকেরা। আর এক পাশে বদলগাছী সাব-রেজিস্ট্রি অফিস-এর জন্য নির্ধারিত স্থান লেখা একটি সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে।

জমির মালিক মৃত মফিজ উদ্দীন আহম্মেদের ছেলে জাহাঙ্গীর সেলিম সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ‘এর আগে গত ২৪ ডিসেম্বর দলিল লেখক সমিতির লোকজন ওই জমিতে থাকা বেশ কিছু আম গাছ কেটে তা দখলের চেষ্টা করেন। এ নিয়ে থানায় অভিযোগও করি। কিন্তু প্রশাসন এখন পর্যন্ত তা মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি। আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও গত রোববার সন্ধ্যা থেকে দলিল লেখক সমিতির লোকজন লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে দলবল বেধে ওই জমিতে স্থাপনা করতে শুরু করে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন ও থানায় অবহিত করি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁদেরকে উচ্ছেদে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, উপজেলা জিধিরপুর মৌজার সাবেক এসএ খতিয়ান নম্বর ২০৭, সাবেক দাগ নম্বর ৪৪ এর কাতে মোট ১ একর ২০ শতক জমি ১৯৭৫ সালে ৯ ডিসেম্বর ২৭২৫৫ নম্বর দলিল মূলে মৃত মশিতুল্লাহ কাজীর ওয়ারিশগনের কাছ থেকে ক্রয় করেন। তাঁর মধ্যে ৭০ শতক জমি সরকার অধিগ্রহন করে টিএন্ডটি অফিস স্থাপন করেন। বাঁকি জমি পৈত্রিক সূত্রে আমি ও আমার অন্য ভাইরা ভোগ দখল করে আসছি। ২০১৩ সালে ওই জমিটি ‘খ’ তফশিল গেজেটভুক্ত হলে আমার বাবা মফিজ উদ্দীন সম্পত্তিটি অবমুক্তির জন্য নওগাঁ সহকারী জজ আদালতে ৩৬৪/২০১৩ মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি নিষ্পত্তি করে প্রকৃত মালিকের নামে নামজারীর আদেশ দেন। এরপর আমার বড় ভাই একেএম ইকবাল হোসেন নামজারীর জন্য গত ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই বদলগাছী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে আবেদন করেন।  কয়েক দফা শুনানি শেষে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এ অবস্থায় ২০১৩ সালে দলিল লেখক সমিতির লোকজন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নামে ওই জমিটি দখলের চেষ্টা করে। এ ঘটনায় আমার বাবা মজিজ উদ্দিন চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে নওগাঁ সহকারী জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত উভয় পক্ষের শুনানী শেষে তখন চিরস্থায়ী স্থিতিবস্থা জারী করেন।

তিনি জানান,আদালতের আদেশ অমান্য করে নওগাঁ জেলা প্রশাসক ২০১৬ সালের ৪ ডিসেম্বর ৫২৫৫ দলিল মূলে বদলগাছী সাব-রেজিষ্টার অফিসের নামে দীর্ঘ মেয়াদী লিজ রেজিষ্ট্রি করে দেন। মফিজ উদ্দিন উক্ত দলিল বাতিল চেয়ে গত ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি জেলা প্রশাসক ও সাব-রেজিষ্টারকে বিবাদী করে নওগাঁ সহকারী জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলা চলমান অবস্থায় বদলগাছী সহকারী কমিশনার (ভূমি) উক্ত জমিটি বদলগাছী সাব-রেজিষ্টারের অফিসের নামে নামজারী করে দেন। পরে আমি নামজারী বাতিল চেয়ে সহকারী কমিশনার ভূমি বরাবরে আবেদন করি। এ অবস্থায় গত ২৪ ডিসেম্বর রাতে সাব-রেজিষ্টারের নেতৃত্বে দলিল লেখক সমিতির লোকজন ওই জমিতে লাগানো আম গাছ কেটে জমিটি দখলের চেষ্টা করেন। রাতেই ইউএনও ও থানার ওসিকে ঘটনাটি জানালে তাঁরা ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশ দখলকারীদের সরমঞ্জাদি জব্দ করে থানায় নিয়ে যায়। এ ঘটনায় আমি বাদী হয়ে থানায় এজহার দাখিল করলেও থানা-পুলিশ বিভিন্ন অজুহাতে মামলাটি এজহারভুক্ত করেনি। যার ফলে গত রোববার সন্ধ্যা থেকে দলিল লেখক সমিতির লোকজন স্থাপনা ও সাইনবোর্ড টাঙিয়ে জবরদখল করে নেয়। এ সময় প্রশাসন ও পুলিশের কাছে অভিযোগ করলেও তারা কোনো প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ না করে নীরব ভূমিকা পালন করে।

বদলগাছী দলিল লেখক সমিতির সভাপতি সেকেন্দার আলী বলেন, সিল্কসিটি নিউজকে ‘সরকার বদলগাছী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নামে ওই জমিটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সেখানে দখলে গিয়েছি।’

বদলগাছী উপজেলার সাব-রেজিস্টার পারভেজ খাঁন জানান, ওই জমিটি নিয়ে আদালতে মামলা রয়েছে। আদালতের রায় যার পক্ষে যাবে তারাই জমিটি পাবে। আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও জমি দখল করতে পারবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।’

বদলগাছী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জালাল উদ্দিন জানান, খবর পেয়ে রোববার সন্ধ্যায় উভয় পক্ষকে থানায় ডেকে নেওয়া হয়। বিরোধপূর্ণ জমি হওয়ায় উভয়পক্ষকে শান্তি অবস্থা বজায় রাখতে বলা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুম আলী বেগ সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ‘জমিটি নিয়ে মামলা রয়েছে। মামলা নিষ্পত্তি না হলে প্রকৃতপক্ষে কেউ দখলে যেতে পারে না। গত রোববার সন্ধ্যায় দলিল লেখক সমিতির জমি দখল করে নিচ্ছে এমন খবর পেয়ে বিষয়টি পুলিশকে জানাই।

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান জেলা প্রশাসকের বদলির আদেশ চলে আসায় বিষয়টি নিয়ে এ মূহূর্তে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে কোনো লাভ হবে না। তাই নতুন জেলা প্রশাসক আসলে অধিকতর তদন্ত করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ড. আমিনুর রহমানের বক্তব্য জানতে বারবার তাঁর ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তাঁর মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
স/শ