রাজশাহী-৪: বাগমারাজুড়ে আতঙ্ক গণগ্রেপ্তার, ফুরফুরে এনামুল

নিজস্ব প্রতিবেদক:
সহিংসতা থেমে গেছে। কিন্তু বন্ধ হয়নি গ্রেপ্তার ও হয়রানি। এই আতঙ্কে গোটা উপজেলাজুড়ে বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরাও এখন আর বাড়িতে থাকতে পারছেন না। বলা যায় রীতিমতো স্টিম রোলার চালানো হচ্ছে তাদের ওপর। আর এই অপকর্মের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাগমারা থানার ওসি নাছিম আহম্মেদ। যাকে অপসারণের দাবি উঠেছে নির্বাচনের আগ থেকেই। আওয়ামী লীগ-বিএনপি এমনকি সাধারণ মানুষও এই পুলিশ কর্মকর্তার অপসারণ চেয়ে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে।

কিন্তু তার অপসারণ তো দূরের কথা বরং রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের বর্তমান এমপি ও আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী এনামুল হকের আশীর্বাদে ওসি আরো ফুলে-ফেঁপে একাকার হয়ে আছেন। এই ওসির দাপটেই বাগমারা এখন প্রায় বিএনপিশূন্য অবস্থা বিরাজ করছে। এরই মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহী নগরী থেকে বাগমারা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সোবহানকে আটক করে পুলিশ। তিনি এলাকা ছেড়ে নগরীতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

প্রায় প্রতিদিনই কমপক্ষে অর্ধশত নেতাকর্মীকে আটক করা হচ্ছে এই বাগমারায়। ফলে বাগমারা যেন আতঙ্কের উপজেলাতে পরিণত হয়েছে বাগমারার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে। এছাড়াও হামলার ভয়ে নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ করে দিয়েছেন বিএনপি প্রার্থী সাবেক এমপি এমপি আবু হেনা। এলাকা ছেড়ে তিনি নগরীর একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান করছেন।

তবে ফুর ফুরে মেজাজে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান এমপি এনামুল হক। গতকাল বাগমারার ভবানীগঞ্জে তার নির্বাচনী জনসভাও অনুষ্টিত হয়। আবার প্রতিদিনই তিনি এবং তার নেতাকর্মীরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন গণসংযোগের মাধ্যমে।

উপজেলার মোহনগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, গোটা বাজারজুড়েই শুধু নৌকার ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন। হাতেগোনা দুই-একটা পোস্টার চোখে পড়ে ধানের শীষের। এই বাজারের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কেউ ভয়ে এখন আর ধানের শীষের নাম নিতে পারছে না। এমপির বাহিনী অথবা পুলিশ এসে তাকে হয়রানি করে যাচ্ছে। দিনে কিংবা রাতে প্রতিদিন বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে গিয়ে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হচ্ছে। মানুষ এই ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। তাই গ্রেপ্তার বা হুমকির ভয়ে এখন কেউ ধানের শীষের কথা বলতে পারছে না। অনেকেই ভয়ে নৌকার লোকজনের সঙ্গেই চলাফেরা করতেও বাধ্য হচ্ছে।’

বাগমারার নরদাস এলাকার বিএনপি সমর্থক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘কেউ এখন আর ধানের শীষের কথা বলতে পারছে না। গ্রেপ্তার আতঙ্কে বিএনপি নেতাকর্মীরা ভয়ে এলাকা ছেড়ে আছে। রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ হয়রানি করে আসছে, গ্রেপ্তার করছে। এই অবস্থায় ভোট দূরের কথা, গ্রেপ্তার এড়ানোই বিএনপি নেতাকর্মীর কাছে প্রধান বিষয় হয়ে আছে। আমার বাড়িতেও অন্তত চারবার পুলিশ গিয়ে হয়রানি করে এসেছে।’

হামিরকুৎসা গ্রামের বিএনপিকর্মী জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ধানের ধীষের প্রার্থী এলাকায় গেলেও তার ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। ভয়ে তিনি আর নির্বাচনী প্রচারণায় চালাচ্ছেন না এলাকায়।’
বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যেভাবে সাধারণ লোকজনকে হয়রানি করা হচ্ছে-এটা অতিতে কখনো দেখিনি। নির্বাচনের নামে গোটা বাগমারায় ত্রাসের রাজত্ব চালানো হচ্ছে।’

ওই নেতা আরো বলেন, ‘মানুষ নৌকা প্রতীকে এমনিতেই ভোট দিবে। কারণ উন্নয়নের প্রতীক হলো নৌকা। কিন্তু এই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে এনামুল হক যা করেছেন-সেটি হয়তো অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। এ কারণেই তিনি ভয়ে আছেন। তাই হয়তো গোটা উপজেলাজুড়ে কাগারে পরিণত করা হয়েছে।’

এদিকে এই আসনের বিএনপি প্রার্থী আবু হেনার ভাতিজা আক্তার হোসেন বলেন, ‘প্রচারণায় গেলেই আমাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। যারা প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে, সেসব নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দিনে-রাতে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে গণহারে। এই কারণে আমরা আর প্রচারণায় অংশ নিচ্ছি না। মানুষ আমাদের প্রার্থীকে আর ভোট না দিলেও আমরা কারো জীবন সঙ্কটের মধ্যে ফেলতে চাই না। তাই আর প্রচারণা চালাবো না। প্রচারণা বন্ধ করে দিয়েছি। প্রার্থী এখন নগরীতে বসে কৌশলে নির্বাচনী কার্যক্রম চালাচ্ছেন।’
এদিকে বাগমারার সাকোয়া এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, ‘এবারো নৌকায় পাশ করবে। কারণ ধানের শীষের লোক মাঠে নামতে পারছে না। সাধারণ মানুষের কাছে যেতে না পারলে মানুষ ধানের শীষকে ভোট দিবে কেন?’

ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা আসুরা বেগম বলেন, ‘যারা আসছে, সবডাই নৌকার লোক। নৌকায় ভোট দিয়্যার কথাই বুলিচ্চে সবাই। তাই ভোটটা নৌকাতেই দিব। এমপি এনামুল আমারেক সাহায্যও করে।’
বাগমারার হাটগাঙ্গোপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নৌকার অবস্থানয় ভালো এখন। কারণ মানুষ কেউ ভয়ে নৌকার বাইরে কথা বলতে পারছে না। আবার বিএনপির মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে সব নেতাকর্মীরাও মাঠে নামেনি। তাই এবারো নৌকায় পাশ করবে বলে মনে হচ্ছে।’

অন্যদিকে জানা গেছে, নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার আগেই গত ১ ডিসেম্বর বাগমারায় প্রকাশ্যে এমপিবিরোধী গ্রুপ তাহেরপুর পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদের অনুসারী শ্রী চ ল কুমারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পরে এখন পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। এমনকি ওই হত্যার সঙ্গে জড়িতদের নামে মামলা দিলেও এমপির হস্তক্ষেপের কারণে তাদের আসামি করেননি ওসি নাছিম আহম্মেদ।

এ নিয়ে ওসির অপসারণ দাবি করেছিলেন তাহেরপুর পৌর মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ। এছাড়াও নির্বাচনের আগ থেকেই ওসি নাছিম আহমেদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার ও হয়রানির অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে। কিন্তু সেই ওসি এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন বাগমারায়। এমপি এনামুলের আর্শিবাদপুষ্ট হওয়ায় ওসি বিএনপি নেতাকর্মীদের আরো বেশি বেশি হয়রানি করছেন বলেও অভিযোগ করেছেন বিএনপি প্রার্থী আবু হেনা।

সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের দপ্তরে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় ওসি নাছিম আহমেদ ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমন দেবের অপসারণ চেয়েছিলেন বিএনপি প্রার্থী আবু হেনা।

 

স/আর