রাজশাহী হাসপাতালে অক্সিজেন সঙ্কটেই বাড়ছে মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

রাজশাহী হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে প্রতিদিন এখন গড়ে ১৩ জনেরও বেশি রোগী মারা যাচ্ছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন। আবার অনেকেই করোনা পজেটিভ হয়েই মারা যাচ্ছেন। যারা সকলেই শ্বাসকষ্ট ও জ্বর-সর্দি বা কাশিতে আক্রান্ত হয়ে রামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। গত এক মাসে এ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মোট মারা গেছেন ৪৩৪ জন। এর মধ্যে প্রায় ৮০ জন মারা গেছেন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ)। আর বাকি প্রায় সাড়ে তিন শ রোগী মারা গেছেন সাধারণ ওয়ার্ডে। যাদের অনেকেই অক্সিজেন তো দূরের কথা হাসপাতালের শয্যাও পাননি। আবার শয্যায় থেকেই অনেকেই হাইফ্লো নেগাল ক্যানালা মেশিনের অভাবে উচ্চ গতিসম্পন্ন অক্সিজেন সরবরাহ না পেয়েও মারা যাচ্ছেন বা গেছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাইরে থেকে সিলিন্ডার কিনে এনে বা পুলিশ, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের দেওয়া সিলিন্ডার সংগ্রহ করেও চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকেই। ফলে অক্সিজেন সঙ্কটেই মারা যাচ্ছেন অধিকাংশ রোগী-এমনটিই দাবি করেছেন রোগীর স্জনরা। হাসপাতালের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করেও এই চিত্র উঠে এসেছে।

রাজশাহী হাসপাতাল থেকে দেওয়া তথ্য মতে, এখন প্রতিদিন এ হাসপাতালের রোগীদের জন্য আট হাজার লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করতে। যার অধিকাংশ ব্যবহার হচ্ছে আইসিইউ এবং এইচডিইউ ওয়ার্ডের রোগীদের জন্য। কারণ এসব ওয়ার্ডের ব্যবহৃত হওয়া প্রায় ৬০টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা মেশিনের মাধ্যমে কোনো কোনো অধিকাংশ অক্সিজেন সরবারহ করতে হচ্ছে। কারণ একেকটা রোগীকে প্রতি মিনিটে ৬০-৮০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ করতে হচ্ছে। ফলে সাধারণ শয্যায় বা মেঝেতে যেসব রোগী ভর্তি আছেন, তাদের পেছনে অর্ধেক অক্সিজেনও সরবরাহ করা যাচ্ছে না হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা মেশিন না থাকায়।

তবে সাধারণ পাইপের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবাহ করা হচ্ছে সাধারণ শয্যার রোগীদের মাঝে। ফলে যেসব রোগীদের আইসিইউ প্রয়োজন হচ্ছে, কিন্তু আইসিইউ সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে না বা হাইফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ করা যাচ্ছে না, করোনার সেসব সাধারণ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীরাই বেশি মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়ছেন।

হাসপাতালের দেওয়া প্রতিদিনের তথ্য চিত্রেও সাধারণ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীদেরই বেশি মৃত্যু লক্ষ্য করা গেছে। এমনকি রোগীর স্বজনরাও দাবি করছেন, আইসিইউ সুবিধা না পেয়েই মারা যাচ্ছে অধিকাংশ রোগী।

রামেক হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার শামীম ইয়াজদানী জানান, গতকাল শনিবার সকাল পর্যন্ত এ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে মারা গেছেন মোট ১৩ জন রোগী। যাদের মধ্যে আইসিইউতে মারা গেছেন ২ জন। আর ১১ জনই মারা গেছেন সাধারণ ওয়ার্ডে। এই ১৩ জনের মধ্যে করোনা আক্রান্ত ছিলেন ৫ জন। বাকিরা করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।

তিনি আরও জানান, গত জুন মাসে এ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে মোট রোগী মারা গেছেন ৪০৫ জন। যাদের মধ্যে ১৮৯ জন ছিলেন করোনা আক্রান্ত। বাকিরা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। আর গত তিনদিনে মারা গেছেন আরও ৫২ জন। যার মধ্যে ৩০ জন উপসর্গ নিয়ে আর ২২ জন করোনা পজেটিভ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এই ৫২ জনের মধ্যে প্রায় ৪৫ জনই মারা গেছেন সাধারণ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। যারা সবাই উচ্চ শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি ছিলেন।

হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ চিকিৎসক আবু হেনা মোস্তফা কামাল  জানান, গত জুনে আইসিইউতে মোট রোগী ভর্তি হয় ১৫৯ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ৭৫ জন। গত তিন দিনে মারা গেছে আরও প্রায় ১০ জন। সেই হিসেবে আগের মাসের তিন দিন বাদ দিলে গত এক মাসের হিসেব ধরা হলে এ হাসপাতালে আইসিইউতে মারা গেছেন সর্বোচ্চ ৮০ জন।

তিনি আরও জানান, হাসপাতালে মোট ৬৯টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে ২১টি রয়েছে আইসিইউতে। আর ২০টি রয়েছে ২৯ ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডগুলোতে আইসিইউএর চেয়ে একটু কম সুবিধার চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাকে বলা হয় এইচডিইউ। আর বাকি ২৮টি দেওয়া আছে হাসপাতালের অন্যানা করোনার ১০টি ওয়ার্ডে। তবে ৪টি মেশিন নষ্ট আছে। ফলে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৬০টি হাইফ্লো মেশিনের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা যাচ্ছে। কিন্তু আইসিইউ রোগীদের যে চাপ তাতে আরও ৪০টি শয্যা করা হলেও এ চাপ সামলানো কঠিন হবে।

চিকিৎসক আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘প্রতিদিন আইসিইউতে যে পরিমাণ রোগী রেফার্ড করা হচ্ছে, আমরা তার একাংশও নিতে পারছি না। ফলে অধিকাংশ রোগীই আইসিইউ সুবধিা পাচ্ছে না।’

এদিকে রামেক হাসপাতাল সূত্র মতে, গত দুই মাস আগে এ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে অক্সিজেন চাহিদা ছিলো মাত্র ২-৩ হাজার লিটার। কিন্তু গত এক মাসে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার লিটার। এক মাস আগে এর চাহিদা ছিলো প্রায় ৫ হাজার লিটার। এখন সেটি বেড়ে গিয়ে প্রতিদিন প্রয়োজন হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার লিটার।

হাসপাতালের ১২টি ওয়ার্ডে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ৪০৫ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি ছিলেন ৪৭৮ জন। ফলে ৭৪ জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে মেঝেতে রেখে। যাদের অক্সিজেন সরবরাহ করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এই রোগীর স্বজনরা বাইরে থেকে অক্সিজেন কিনে নিয়ে এসে তাঁদের রোগীর জন্য ব্যবহার করছেন।

হাসপাতালে মৃত্যু হওয়া রোগী শিপলার স্বামী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার স্ত্রী অক্সিজেন সঙ্কটের কারণেই মারা গেছেন। তাঁর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট দেখা দিলেও পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়নি হাসপাতালের মেঝেতে। ফলে ভর্তি হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আমার স্ত্রী মারা গেছেন।’

শুধু শিপলার স্বজনই নন, প্রতিদিন যেসব রোগী মারা যাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশ স্বজনেরই একই অভিযোগ আইসিইউ না পেয়ে বা পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পেয়ে রোগী মারা গেছে।’