রাজশাহী মহানগর আ.লীগে এবার বিতর্কিত-নিস্ক্রিয়দের চায় না তৃণমূল

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বিলুপ্ত হওয়া কমিটির বিতর্কিত নেতাদের এবার নতুন করে নেতৃত্বে চান না রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তাঁদের দাবি, আগের কমিটির অধিকাংশ নেতা পদ বাগিয়ে নিয়ে প্রায় ৫ বছর ধরে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন বা সুবিধা আদায় করে গেছেন। কিন্তু দলের জন্য কোনো কাজে আসেননি। এমনকি দলীয় সভা-সেমিনারেও অধিকাংশ সময় দেখা যায়নি পদধারী অনেক নেতাদের। আবার কেউ কেউ দলীয় সিদ্ধান্তকেও বুড়ো আঙ্গল দেখিয়েছেন ক্ষমতা এবং অবৈধা টাকার জোরে। তবে এসব নেতাদের আর পদে দেখতে চান না তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এবার বিতর্কিত বা পদ নিয়ে সুবিধা আদায়কারী নেতাদের আবারো পদে বসানো হলে কঠোর অবস্থানে যাবেন বলেও জানিয়েছেন অনেকে। প্রয়োজনে রাজনীতি গুটিয়ে নিয়ে সংসারে মনোযোগ দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন কেউ কেউ।

দলীয় সূত্র মতে, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয় ৭১ সদস্যের। গত ১ মার্চ পুরনো কমিটি ভেঙে দিয়ে ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনের মাধ্যমে শুধুমাত্র সভাপতি-সম্পাদকের নাম ঘোষণা করে আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। যদিও আগামী এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের জন্য সভাপতি-সম্পাদককে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর আগে ২০১৪ সালের ২৫ আক্টোবর সম্মেলনে সভাপতি পদে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের নাম ঘোষণা করে এবং কাউন্সিলদের ভোটের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক পদে ডাবলু সরকার নির্বাচিত হয়েছিলেন। সর্বশেষ সম্মেলনে এবার কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের লিটন-ডাবলুর নাম সারসরি ঘোষণা করে তাঁদের স্বপদে বহাল রাখেন।

এর আগেও ২০১৪ সালে আংশিক কমিটি গঠনের পর লিটন-ডাবলুকে এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই কমিটি গঠন করতে কেটে গেছিলো এক বছর। পরবর্তিতে কেন্দ্রের অনুমোদনে ৭১ সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিলো ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর।

দলীয় সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিগত কমিটির ৭১ সদস্যের মধ্যে শুধুমাত্র পদ বাগিয়ে নিয়ে নানাভাবে সুবিধা আদায় ও বিতর্কে জড়ানো এবং দলীয় কর্মসূচিতে অংশ না নিয়ে নিস্ক্রিয় ছিলেন এমন নেতাদের সংখ্যায় বেশি। তাদের মধ্যে ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল আলম বেন্টু। সদ্য অনুষ্ঠিত হওয়া কাউন্সিলের আগে মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি সভায় করা রেজুলেশন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত মানেননি বলেও এই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। সিদ্ধান্ত অম্যান্য করে ছাত্রলীগ নেতা গোলাম মূর্শিদ হত্যা মামলার আসামি আজিজুল আলম বেন্টু নিজের ছবিযুক্ত ব্যানার ও ফেস্টুনে ভরিয়ে দেন গোটা শহর। এছাড়াও ১৪ দলের অন্যতম শরিক দল ওয়াকার্স পার্টির সমাবেশের প্রচারণা সামগ্রীর ওপরও এই বেন্টুর ব্যানার-ফেস্টুন টাঙ্গানো হয়। এ নিয়ে ওয়াকার্স পার্টি থেকে থানায় জিডি পর্যন্ত করা হয়। পাশাপাশি ১৪ দলে ভাঙ্গন সৃষ্টির চেষ্টার অভিযোগও উঠে এই বেন্টুর বিরুদ্ধে। এর বাইরে শহরের বালুমহালকে কেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় উঠে আসেন তিনি। এমনকি ভোটারদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে এমন আশঙ্কায় গত সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও এই বেন্টুকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর হয়ে প্রচারণায় মাঠে নামতে দেওয়া হয়নি।

এদিকে অপর দুই সাংগঠনিক সম্পাদক মধ্যে আসাদুজ্জামান আজাদ ও অ্যাডভোকেট আসলাম সরকার কর্মহীন নেতা বলে পরিচিতি। যদিও আসলাম সরকার দলের পেছনে ব্যাপক শ্রম দেন।

এছাড়াও পদ পেয়েও নিস্ক্রিয় ও দল থেকে নানা সুবিধাভোগের তালিকায় যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন যুগ্ম-সম্পাদক মোস্তাক হোসেন, কর্মীহীন নেতা বলে পরিচিত কৃষিবিষয়ক সম্পাদক জহির উদ্দিন তেতু, নিস্ক্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত সাইদুর রহমান রেন্টু, বিএমডিএ’র ঠিকাদারী নিয়ে সময় কাটিয়েছেন ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক ফিরোজ কবির সেন্টু, কর্মীহীন ছিলেন দপ্তর সম্পাদক মাহবুব-উল আলম বুলবুল, নিস্ক্রিয় ছিলেন ধর্মবিষয়ক সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম জাহিদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ওয়াহেদুন্নবী অনু ছিলেন চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, বিভিন্ন ভাতা প্রদানের নামে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ইয়াসমিন রেজা ফেন্সির বিরুদ্ধে , যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক মীর তৌফিক আলী ভাদু ছিলেন নিস্ক্রিয়, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক শ্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর শাহার বিরুদ্ধে রয়েছে আন্তজার্তিক মাদক সম্রাটি শীষ মোহাম্মদকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ, শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক এ এস এম ওমর শরীফ রাজিব ছিলেন নিস্ক্রিয়, নানা অভিযোগে দল থেকেই সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন শ্রম সম্পাদক মাহাতাব হোসেন চৌধুরী, আর কোষাধ্যক্ষ শামসুজ্জামান আওয়াল থাকেন ঢাকায়।

এছাড়াও ৩৪ জন সদস্য পদ পেয়েও নিস্ক্রিয়দের তালিকায় ছিলেন ডাক্তার তবিবুর রহমান শেখ, আখতারুল আলম, শফিকুজ্জোহা, কামরুজ্জামান কামরু, বিএনপি থেকে আসা একেএম রাশেদুল হাসান টুলু, মখলেসুর রহমান খলিল, লক্ষীপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক আইরিন পারভীন, এবিএম হাবিবুল্লাহ ডলার, সাহাব উদ্দিন, বেলাল হোসেন, আল মামুন, এটিএম শফিকুর রহমান ও খাজা আহমেদ। এর বাইরেও আরো অনেকে ছিলেন টেন্ডারবাজ, ভূমিদস্যূসহ নানা অভিযোগে বিতর্কিত।

রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আমিনুর রহমান রুবেল বলেন, ‘যে নেতা ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যা করে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়, তাকে আওয়ামী লীগে পদ দেওয়া হয় কিভাবে। গত ৫ বছর ধরে আমরা এ নিয়ে চরম কষ্টে ছিলাম। এবার আশা করি জনপ্রিয় ছাত্রলীগ নেতা গোলামের মতো ব্যক্তিকে যারা খুন করতে পারে, সেসব খুনিদের মহানগর আওয়ামী লীগে যায়গা হবে না। এই ধরনের নেতাকে এবার পদ দেওয়া হলে আমরা সেটি মেনে নিব না।’

তৃণমূলের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এবার টেন্ডারবাজ, ভূমিদস্যূ, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যারা গত ৫ বছরে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন, তাদের নতুন কমিটিতে না রাখার জন্য দাবি জানানো হবে সভাপতি-সম্পাদকের কাছে। তার পরেও যদি এসব নেতোকে আশ্রয় দেওয়া হয়, তাহলে আমরা সেটি মেনে নিব না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক নেতা বলেন, দলের পেয়ে যারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, আবার দলের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন এসব নেতাদের আর ছাড় দেওয়ার সুযোগ নাই। রাজশাহী আওয়ামী লীগের কর্ণধার ও সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এবং তরুণ নেতা ডাবলু সরকার এবার বিষয়টি ভেবে দেখবেন আশা করি।

মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার বলেন, ‘বিতর্কিত কোনো ব্যক্তিকে এবার পদে রাখা হবে না। কেন্দ্রীয় নেতাদের সেই নির্দেশনাই আছে আমাদের কাছে। কাজেই এবার আমরা দলের জন্য ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান নেতাকেই যায়গা দিব।’

তবে এবার আর নিস্ক্রিয়, ভূমিদস্য, টেন্ডারবাজ, হত্যা মামলার আসামিদের দলে যায়গা দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি বলেন, আমরা এবার দলেল ত্যাগী নেতাদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করবো। যারা দলের জন্য শ্রম দেন, সেসব নেতাই আমাদের প্রয়োজন।

স/আর