রাজশাহী অঞ্চলে প্রতিদিন দেড় লাখ মানুষকে পণ্য দিচ্ছে টিসিবি, ভিড় তবুও

নিজস্ব প্রতিবেদক:

শনিবার বেলা সকাল ১১টা। রাজশাহী নগরীর লক্ষীপুর এলাকায় টিসিবির পণ্য বিক্রির ট্রাকের সামনে নারী-পুরুষের দুটি লাইনে পন্য নিেিত দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রায় ২০০ মানুষ। কেউ তেল নিতে, কেউ তেল ডাল ও চিনি তিনটাই নিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তীব্র রোদ আর গরমের মধ্যে কেউ কেউ ছাতা মাথায় দিয়েও দাঁড়িয়েছিলেন। মাথার ওপরে কিছুই না থাকায় রোদে আর গরমে ঘেমে একাকার অধিকাংশই।

সামাজিক নিরাপত্তা দূরুত্তের জন্য বার বার তিন মিটার দূরুত্বে থাকার কথা বলা হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। কিন্তু টিসিবির পণ্য নিতে লাইনে দাঁড়ানো এসব লোকরা কখনো কখনো ঠেলাঠেলিতেও জড়িয়ে পড়ছেন। ভিড় ঠিক রাখতে পাশের পুলিশ বক্সের দায়িত্বরত সদস্যরা বার বার লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলো একটু করে দূরুত্বে সরিয়ে দিচ্ছেন। আবার হ্যান্ড মাইকেও বার বার করে নিরাপদ দূরুত্বে দাঁড়াতে বলা হচ্ছে। কিন্তু অসেচতন এই মানুষগুলোর লক্ষ্যই হলো দ্রুত পণ্য নিয়ে বাড়িতে ফেরা।

জানা গেছে, এদের অনেকেই নিম্নবিত্ত, কেউ নিম্নমধ্যবিত্ত আবার কেউ মধ্যবিত্ত। তবে মধ্যবিত্তের সংখ্যায় কম। অন্য দুটি শ্রেণির মানুষই বেশি। যাদের একটি বড় অংশ নারী। এদের মধ্যে একজন নারী হলেন, আয়েশা খাতুন। তিনি লক্ষীপুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি বলেন, বাসায় তরকারি ফুরায় গেছে। তাই ডাল নিতে অ্যাসেছি। সেই এক ঘন্টা ধরে ডালের জন্য দাঁড়ায় আছি। কিন্তু কখন পাবো জানি না। ডালের সঙ্গে তেলও নিব দুই লিটার।’

আয়েশা আরো বলেন, ‘পরের বাড়িতে কাজ করি। কিন্তু করোনা আতঙ্কে এই মাস থেকে কাজে য্যাতে নিষেধ করেছে। গত মাসের কাজ করে যে ট্যাকা পাইছি, সেটা দিয়েই কোনো মতে চলতে হচ্ছে। এই টাকাও কয়দিন পরেই ফুরায় যাবে। তখন কি দিয়ে বাজার-সুদা করি খাবো ব্যুঝতে প্যারছি না।’

লক্ষীপুর থেকে আরেকটু উত্তর দিকে নগরীর বহরমপুর বাইপাশ মোড়েও টিসিবির আরেকটি ট্রাকে করে বিক্রি করা হচ্ছে পণ্য। এখানেও দেখা গেলো প্রচণ্ড ভিড়। ভিড় সামলাতে পুলিশ গিয়ে লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে নিরাপদ দূরুত্বে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু একটু পরেই আবার গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন লাইনের লোকগুলো।

গতকাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শুধু এই দুটি স্থানেই নয়, নগরীতে টিসিবির ১০ টি ট্রাকের সামনেই প্রতিদিন শত শত মানুষের ভিড় লেগে থাকছে। একেকটি ট্রাকে তেল, চিনি ও ডাল মিলে গড়ে ৫-৬টন করে পণ্য দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তার পরেও ভিড় থামানো যাচ্ছে না। ফলে করোনা ছড়িয়ে পড়ারও আতঙ্কও দেখা দিয়েছে মানুষের মাঝে।

লাইনে দাঁড়ানো ষাটার্ধ আকবর আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘শুনেছি আমাদের বয়সের মানুষরা এমনিতেই বেশি করোনা ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু বাধ্য হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে তেল আর ডাল নিতে অ্যাসেছি। আমাদের তো বেশি ট্যাকা জমা নাই, যে বেশি দামে বাজার থেকে কিনে নিয়ে গিয়ে খাবো। যে দুই-চার টাকা বাঁচানো যাবে, সেটা দিয়ে অন্য দুই-একটা বাজার হয়তো করা যাবে। এই আশায় টিসিবির ডাল আর তেল নিতে অ্যাসছি। সময় পেলে এখান থেকেই তেল নিয়ে যায়, তাতে কেজিতে অন্তত ৬০ টাকা বাঁচে। তবে ভিড় কমাতে আরো বেশি করে ট্রাক নামানো উচিত টিসিবির।’

একই দাবি জানান, মোস্তাক হোসেন নামের আরেক ব্যক্তি। প্রতিদিন এভাবেই ভিড় থাকছে। আর ভিড় করা যাবে না বলে প্রশাসন থেকে বার বার বলা হচ্ছে। তা হলে এতো অল্প ট্রাকে করে কেনো মাল (পণ্য) দেওয়া হচ্ছে। ট্রাক আরো বাড়ানো উচিত। না হলে কোনো দূরুত্ব তো থাকছে না। লাইনে দাঁড়ানো মানুষের মাঝে।’

টিসিবি সূত্র মতে, শুধু রাজশাহী শহরেই দেওয়া হচ্ছে ১০টি ট্রাকে পণ্য। এর মধ্যে জনপ্রতি চিনি ২ কেজি, ডাল ১ কেজি ও সোয়াবিন তেল ২-৫ কেজি করে দেওয়া হচ্ছে। আর এসব পণ্য কিনতে প্রতিদিনই একেকটি ট্রাকে গড়ে অন্তত ৬ হাজার মানুষের মাঝে এসব পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। সেই হিসেবে রাজশাহী নগরীতে ১০টি ট্রাক থেকে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৬০ হাজার মানুষ টিসিবির পণ্য কিনতে ভিড় করছেন।

টিসিবির রাজশাহীর আঞ্চলিক উপপরিচালক প্রতাপ কুমার জানান, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পাবনা জেলা মিলে প্রতিদিন ২৪টি ট্রাকে করে ১০০-১১০ মেট্রিকটন পণ্য বিক্রি হচ্ছে। আর এসব পণ্য কিনতে প্রতিদিন অন্তত দেড় লাখ মানুষ ভিড় করছেন।

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, প্রতিদিন যে হারে মানুষকে পণ্য দেওয়া হচ্ছে, তাতে এতো ভিড় থাকার কথা নয়। কিন্তু মানুষ পণ্য কিনে কি করছেন বুঝতে পারছি না। কারণ সমাজের মাত্র দুটি শ্রেণির মানুষই বেশি লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। তাঁরা হলেন, নিম্নবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্ত। আর কিছু মানুষ লাইনে দাঁড়াচ্ছেন মধ্যবিত্ত। কাজেই এতো ভিড় তো হওয়ার কথা নয়। তাহলে টিসিবির পণ্য কিনে কেউ কেউ দোকানে গিয়ে বিক্রি করছেন কিনা সেটিও ক্ষতিয়ে দেখা দরকার। তবে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত পণ্য মজুদ আছে।’

স/আর