বেতের একাল-সেকাল

রাজশাহীর হোসনিগঞ্জ নামেই বেতপট্টি


শাহিনুল আশিক:


রাজশাহীতে একটিমাত্র এলাকা ছিল হোসনিগঞ্জ। সেখানে বেতের জিনিসপত্র বিক্রির বেশ কিছু দোকান গড়ে উঠায় বেতপট্টি নামে পরিচিত লাভ করে এলাকাটি। বেতপট্টিতে এক সময় রাস্তার দু’পাশে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৪টি দোকান ছিল। এখন বেতপট্টিতে সিদ্দিক, ফরিদুর ও আব্দুল কাদের মিলে তিনটি দোকান ছাড়া চোখে পড়েনা।

তবে দোকানগুলোতে বেতের তৈরি কিছু কিছু জিনিপত্র পাওয়া গেলেও তুলনায় কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘এক সময় এই বেতপট্টির দু’পাশে ১২ থেকে ১৪টি দোকান ছিল। কিন্তু বেতের তৈরি জিনিসের চাহিদা কমায় অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এখন মাত্র তিনটি দোকান। দোকানগুলোতে বেশির ভাগ বেতের তৈরি মালামাল নগরের বহরমপুর বাইপাস থেকে কিনে এখানে বিক্রি করা হয়।



আরও পড়ুন: চ্যালেঞ্জের মুখে রাজশাহীর বেত শিল্প


বেত:


বহরপুরের বিচিত্রা দোকানের কারিগর আব্দুর রাজ্জাক জানান, সবচেয়ে বেশী উৎপন্ন বেত ইন্দোনেশিয়ায়। ইন্দোনেশিয়ায় উৎপন্ন বেতের গুণগতমানও সবচেয়ে উন্নত। এছাড়া ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মায়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডেও বেত জন্মায়।

তবে রাজশাহীতে মিয়ানমার (বার্ম), ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে বেত আসে। ইন্দোনেশিয়ার বেতের দাম সবচেয়ে বেশি। মিয়ানমার থেকে আসা প্রতিটি বেতের দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। যা ১০ থেকে ১২ ফুট লম্বা। এছাড়া দেশি বেত মোটা ১০০ টাকা ও পাতলা (ফালি বেত) ২৫ থেকে ৫০ টাকা। ভাতীয় বেত কিনতে হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার বেত ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা। যা ১০ থেকে ১২ ফুট লম্বা। আর ফালি (পাতলা) বেত ৭০০ টাকা কেজি।


বেতের আসবাবে নান্দনিক গৃহসজ্জা | অভিযাত্রা


হোসনিগঞ্জ থেকে এলাকার নাম বেতপট্টি:


৬৫ বছর ধরে বেতের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রির ব্যবসা করছেন ফরিদুর রহমান। তখন এই এলাকার নাম ছিলো হোসনিগঞ্জ। সেই সময় রাজশাহী কোর্ট ও সাহেববাজার রাস্তার দক্ষিণে বেত ও বাঁশের তৈরি মালামাল বিক্রি করতেন ফরিদুরের চাচাতো ভাই মো. নাইমুল্লাহ।

নাইমুল্লাহ ১৯৫৪ সালের শুরু দিকে সিলেট থেকে রাজশাহীতে আসেন ব্যবসায়ীর উদ্দ্যেশে। সর্বপ্রথম তিনি বেত ও বাঁশের তৈরি জিনিস বিক্রি শুরু করেন নগরের হোসনিগঞ্জ এলাকা। তার পরের একে একে করে ১২ থেকে ১৪টি দোকান গড়ে উঠলে বেতের তৈরি জিনিসের। আস্তে আস্তে এই এলাকার মূল নাম হোসনিগঞ্জের পরির্বতে মানুষের কাছে বেতপট্টি হিসেবে পরিচিত লাভ করে। এখনও মানুষ বেতপট্টি হিসেবেই এই এলাকাকে জেনে।


আমাশয়সহ নানা রোগের ওষুধ 'বেত ফল'


 

ব্যবসায়ী ফরিদুর রহমানের কথায় বেতপট্টির শুরু:


চাচাতো ভাই নাইমুল্লাহ সিলেট থেকে বিভিন্নভাবে মালামাল নিয়ে আসতেন রাজশাহীতে। এর পরে এই বেতপট্টিতেই সেগুলো সাজিয়ে ব্যবসা করতেন। পরবর্তিতে এখানে দোকান দেন তিনি। এভাবে ব্যবসা বড় হতে শুরু করে। তখন একটি মাত্র বেতের দোকান নাইমুল্লার। এছাড়া এই হোসনিগঞ্জ বর্তমান বেতপট্টিতে কোন দোকন ছিল না।

১৯৫৬ সালের প্রথম দিকে রাজশাহীতে চাচাতো ভাই নাইমুল্লার কাছে আসি আমি (ফরিদুর)। যদিও প্রথমে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলাম। পরের দিকে ভাই নাইমুল্লার কাছে আসি। তিনি এই বেতপট্টি এলাকায় ব্যবসা করতেন চট্টগ্রাম সিলেট থেকে মালামাল কিনে। আমি (ফরিদুর) আসার কিছু দিন পরে ভাই নাইমুল্লা দেশের বাড়ি সিলেটে যান আমাকে (ফরিদুর) রেখে। এর বেশি কিছু দিন পরে ফিরে আসেন ভাই। তখন আমি (ফরিদুর) বাড়িতে যায়। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। আমার (ফরিদুর) এসএসসি পরীক্ষার সময় ঘুনিয়ে আসে। টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে রাজশাহী চলে আসি। আর দেওয়া হয়নি এসএসসি পরীক্ষা। তার পরে ভাইয়ের দোকানে কাজে লাগি।

তিনি বলেন, তার পরে আর সিলেটে তেমন যাওয়া হয় না। আমি বাড়িতে ১৫ থেকে ২০ বছর পর পর যায়। এখন রাজশাহীর মানুষ হয়ে গেছি। চার ছেলে-মেয়ে। এর মধ্যে ছোট ছেলে মাহাবুবুর রহমান এই পেশায় আছে। সে ইন্টার পাস করেছেন। সে ছাত্রজীবন থেকেই আমার সাথে কাজ করতো।

তিনি বলেন, এখন আর সেই ব্যবসা নেই। আমাদের দোকান দেখা-দেখি এক সময় এই ছোট রাস্তার দুই ধারে প্রায় ১২ থেকে ১৩টি করে দোকান ছিল। সেই সময় বেশি দোকান থাকলে কি হবে ব্যবসা ভালো হতো। ওই সময়ে যে সোফা সেট ২৫০ টাকা ছিলো। এখন সেই সোফা সেটের দাম ২০ হাজার টাকা। বেতের জিনিস নষ্ট হয় কম, দীর্ঘদিন চলে। তাই চাহিদা ভালো ছিল। কিন্তু লোহার, স্টীল এসে বেতের কদর কমে গেছে। এখন এই বেতপট্টিতে মাত্র তিনটি দোকান। তাও আবার বেতের জিনিসপত্র তেমন তৈরি করা হয় না। বেশির ভাগ কিনে এনে বিক্রি করা হয়। এখন বেশি বাঁশ দিয়ে তৈরি সাইকেলের ঝুঁড়ি তৈরি করে বিক্রি করা হয়।


৬ মাসে ১৪ লাখ টাকার বেতের পণ্য বিক্রি করেছেন সুলতানা


এখন নামেই বেতপট্টি:


ঠিক তাই এখন নামেই বেতপট্টি। রাজশাহী শহরে একটি বেতপট্টি রয়েছে যার মূল নাম হোসনিগঞ্জ। ছোট্ট একটি রাস্তার দুধারে ১২ থেকে ১৪টি বেতের আসবাবপত্র তৈরি ও বিক্রি দোকান। তাই সহযেই মানুষের কাছে বেতপট্টি হিসেবে পরিচিত লাভ করে।
একসময় বেতের তৈরি জিনিসের রমরমা ব্যবসা হতো এখানে।

এখানে বেতের তৈরি সোফা, টেবিল, চেয়ার, মুড়া, বাইসাইকেলের ঝুঁড়িসহ নানা জিনিস পাওয়া যেত। কিন্তু এখন সেই ব্যবসা নেই। হাতেগুনা কয়েকটি জিনিস তৈরি হয় এখানে। বেতের দলনা, ঝুল্লু অল্প পরিষরে তৈরি করা হয়। তবে বেশির ভাগ বাইরে থেকে কিনে এখানে বিক্রি করে বিক্রেতারা।

বিক্রেতা মোহাম্মদ আলী জানান, ‘কালের বির্বতণের ফলে বেতের জিনিপত্র হারিয়ে যাচ্ছে। একসময় এখানে ১২ থেকে ১৪টি দোকান ছিল। কিন্তু এখন মাত্র তিনটি দোকান রয়েছে। তাও আবার চলে না। বহরমপুর বাইপাস মোড় থেকে বেতের তৈরি জিনিসপত্র কিনে এনে এখানে বিক্রি করা হয়। এখন মাত্র তিনটি দোকান নিয়ে বেতপট্টি।’


বাঁশ-বেতে সাজাই ঘর - banglanews24.com


কারিগর:


কারিগর ফুয়াদ হোসেন জানান, ‘আমার বাবা খাইরুল ইসলামও এই পেশায় ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন এই কাজ করেছেন। বাবার সাথে থেকে কাজ দেখতে দেখতে এখন আমার এটা পেশায় পরিণত হয়েছে। ১২ থেকে ১৫ বছর ধরে এই কাজ করছি।’

মুজরির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন কাজের অবস্থা ভালো না। বেতের কাজের চেয়ে বাঁশের কিছু জিনিসপত্র তৈরির অর্ডার বেশি পাই। একটি সাইকেলর ঝুঁড়ি তৈরি করলে ৫০ টাকা করে পাওয়া যায়। আর সেই ঝুঁড়ি বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১৮০ টাকা।’


স/আ