রাজশাহীর রাসেল হত্যাকাণ্ড: বাদীর অজান্তেই মামলার আসামি তারা!

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অভাবের সংসারের হাল ধরতে বছর কয়েক আগে পড়ালেখা ছেড়ে অটোরিকশা চালান শুরু করে সিহাব হোসেন রনি (বাপ্পী)। তবে এখন সে রয়েছে কারাগারে। রাজশাহীতে খুন হওয়া যুবলীগকর্মী রাসেল হত্যামামলার আসামি আরেক বাপ্পীর পরিবর্তে আড়াই মাস ধরে কারাভোগ করছে সে। হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে বাপ্পীর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে বৃদ্ধ বয়সে তার বাবাকে চালাতে হচ্ছে রিকশা, গোদ রোগে আক্রান্ত মা খাটছেন অন্যের বাসা-বাড়িতে। শুধু বাপ্পীই নয়, তার মত আরো পাঁচজন এই মামলার আসামি হয়েছে। তবে যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের ব্যাপারে বাদীর জানা নেই। হদিস নেই মূল অভিযুক্তদেরও।

এদিকে এই ঘটনার অন্যতম হোতা সাইদ মাহমুদ হিমেলকে মামলার আসামী করা হয়নি। কিন্তু তিনি নিজেকে বাঁচাতে ঘটনার পর থেকে ঢাকায় পলাতক রয়েছেন। এই হিমেল রাজশাহী রেলওয়ের সরাঞ্জম শাখায় টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার সঙ্গে একটি টেন্ডারের বিরোধের জের ধরেই হত্যাকাণ্ডটির ঘটনা ঘটে। বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। হত্যাকাণ্ডের আগের দিন একই ধরনের আরেকটি টেন্ডার নিয়ে মূলত সানোয়ারের ভাই যুবলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন রাজার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পরের দিন আরেকটি টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পক্ষ প্রকাশ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এসময় সবার সামনে কুপিয়ে জখম করা হয় সানোয়ার ও আনোয়ার হোসেন রাজাকে। এতে তারা দুজনই মারত্মক জখম হন। পরে ওদিনই মারা যান সানোয়ার হোসেন।

গত বছরের ১৩ নভেম্বর পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের টেন্ডার নিয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ ও মহানগর বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। এতে যুবলীগকর্মী সানোয়ার হোসেন রাসেল ছুরিকাঘাতে খুন হন। পরে রাসেলের ভাই মনোয়ার হোসেন রনি বাদী হয়ে ১৭জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো আটজনের নামে নগরীর চন্দ্রিমা থানায় হত্যামামলা করেন।

ভুক্তভোগী ওই ছয়জন হল নগরীর শিরোইল কলোনি এলাকার জয়নাল আবেদীনের ছেলে বাপ্পী (১৯), নুর মোহাম্মদ সরদারের ছেলে মো. শাহিন (২৪), মানিক মিয়ার ছেলে শুভ (২১), বাবু ইসলামের ছেলে চঞ্চল (১৯), মো. জালাল উদ্দীনের ছেলে মো. কালাম উদ্দীন, আবুল কালাম চৌধূরীর ছেলে মো. মোজাহিদুল ইসলাম অভ্র। শাহিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। কালাম ও অভ্র নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাদের বয়স ১৫ বছর হলেও এজাহারে ১৯ বছর দেখানো হয়েছে। এই দু’জন ছাড়া অন্যরা কারাগারে আছে। এদের বেশিরভাগই আবার দরিদ্র পরিবারের ছেলে।

রাসেল হত্যাকাণ্ডের পর এলাকাবাসী নগরীজুড়ে পোস্টার সাঁটায়। পোস্টারে হত্যাকাণ্ডে জড়িত দাবি করে বাপ্পী, শাহিনসহ আটজনের নাম ও ছবি ছাপানো হয়। কিন্তু তাদের পরিবর্তে কারাভোগ করছে অন্য বাপ্পী-শাহীনরা।
এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ক্রাইম সিনের আশে-পাশে বেশ কয়েকটি সিসি ক্যামেরা আছে। পুলিশ চাইলেই সেখান থেকে জড়িতদের চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু পুলিশের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। নিরপরাধ ও নিরীহদের পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তারা এও জানায়, ঘটনার দিন থানায় মামলা হয় মধ্যরাতে। অথচ সন্ধ্যাবেলাতেই তাদেরকে আটক করা হয়। মূল আসামিদের আড়াল করতেই পরিকল্পিতভাবে পুলিশ এমন করেছে বলে দাবি তাদের।

উল্লেখ্য, ঘটনার দিন শাহিন ইন্টার্নশিপের কাজে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সন্ধ্যায় রাজশাহীতে ফিরে কলোনির একটি দোকানে শেভ করাচ্ছিলেন। বাকি পাঁচজন কলোনির একটি দোকানের সামনে বসে গল্প করছিল। এ সময় পুলিশ তাদেরকে আটক করে।

শাহিনের মামা সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি তৎক্ষণাত থানায় গিয়ে শাহিনকে আটকের কারণ জানতে চান। পুলিশের সঙ্গে এ নিয়ে সাইফুল ইসলামের তর্কও হয়। পরে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দেয় পুলিশ। কিন্তু পুলিশ কৌশলে এজাহারে আটককৃতদের নাম ঢুকিয়ে দেয়।

বাপ্পীর মা মোসা. আশা গোদ রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন থেকে ভুগছেন। চিকিৎসার পনেরো হাজার টাকা জোগাড় না হওয়ায় চিকিৎসা করাতে পারছেন না। শুভ’র বাবা মানিক মিয়া শিরোইল বাসস্ট্যান্ডে টিকিট মাস্টার হিসেবে কাজ করেন। চঞ্চল রিকশা চালাত। আর তার মা চম্পা এক চোখ অন্ধ নিয়েও পিঠা বিক্রি করে সংসার চালান।

সরেজমিনে গত বুধবার (২৯.০১.২০) গ্রেপ্তারকৃত ছয়জনের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়। বাপ্পীর মা মোসা. আশা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আসল বাপ্পীকে না ধরে আমার বাপ্পীকে ধরে নিয়ে গেছে। পুলিশ আমাদের কথা শুনছেই না। জেলহাজতে গেলে টাকা লাগে। আমি গরিব মানুষ, আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না।’ এ ঘটনার পর বাদীর সঙ্গে ভুক্তভোগীদের পরিবার একাধিকবার যোগাযোগ করেছেন। বাদী এজাহার থেকে তাদের সন্তানদের নাম বাদ দেবে বলে জানালেও এখনও তা করা হয়নি।

বাদী মনোয়ার হোসেন রনি বলেন, ‘মামলা করেছিলাম ঘটনার দিন রাতে। অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করেছিলাম। তবে মূল আসামিরা এখনও ধরা পড়েনি।’ তাহলে কারা গ্রেপ্তার হয়েছে প্রশ্নে পুলিশই সেটা ভাল বলতে পারবে বলে জানান তিনি। জিজ্ঞাসা করলেও এর বেশি কিছু বলেননি তিনি।

এ বিষয়ে আইনজীবী মো. মোকলেসুর রহমান স্বপন  বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডে শাহিন ও বাপ্পীসহ বাকিরা যে জড়িত নন সে সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র আদালতে পেশ করা হয়েছে। দু’জনের জামিন হয়েছে। এখন বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম শুক্রবার দুপুরে মুঠোফোনে  বলেন, ‘মামলার তদন্ত তো আর গ্রেপ্তারকৃতদের পরিবার করবে না, যারা তদন্ত করছে তারাই এই বিষয়টি ভাল বুঝেছে।’ তবে মামলা হওয়ার আগে তাদেরকে কেন আটক করা হয়েছিল প্রশ্নের জবাবে তিনি কিছু জানেন না বলে মন্তব্য করে ফোন রেখে দেন। পরে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।