রাজশাহীর মরতে বসা পদ্মার চরে ফসলের সমারোহ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বর্ষা এলেই কেবল পদ্মা যেন তার রুপ ফিরে পায়। বর্ষা শেষ তো পদ্মা যেন মৃতপ্রায় একটি নদীর নাম। রাজশাহী নগরীর শ্রীরামপুর এলাকা থেকে পদ্মার দিকে তাকালে কখনো কখনো মনেই হয় না এখানে নদী আছে। ফসলে ফসলে চারিদিকে সবুজে ভরে আছে পদ্মার বুক। শ্রীরামপুর থেকে পশ্চিমে যতদূর চোখ যায়, তত দূরই যেন কেবল চর আর চর। আর এই বিশাল চরে জেগে আছে ফসলের সমারোহ। আবার কোথাও কোথাও ধু-ধু বালু চর। একেবারে তিন কিলোমিটার দূরে ফসলের মাঠগুলো ভরে আছে সরিষা আর মশুর ক্ষেতে। কোথাও কোথাও হচ্ছে ধানচাষও। তবে রাজশাহীর পদ্মা চরের এ বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠের অধিকাংশজুড়েই এখন স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে। এই প্রভাবশালীদের দাপটে যুগ যুগ ধরে পদ্মার চরে ফসল ফলানোর কাজে যারা ব্যস্ত থাকেন, তাদের অধিকাংশই এখন কোণঠাসা। তারা আবার কেউ জমি বর্গা নিয়েও ফসল ফলাচ্ছেন।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজশাহীর পদ্মা গার্ডেনের নিচ থেকে শুরু করে পশ্চিমে একেবারে শ্রীরামপুর এলাকা পর্যন্ত শত শত হেক্টর চর জেগে আছে। মাঝখানে একটি নালার মতো সরু এলাকায় পানি জমে আছে। তবে কোনো প্রবাহ নেই। আর এই মাঝখানের দু’পাশ জুড়েই ফসলের সমারোহ। পদ্মা গাডের্ন থেকে পূর্ব থেকে সামান্য পানি পার হলেই শুধু বালি আর বালি। যেন ধু ধু বালুচর জেগে ওঠা পলি মাটির জমিতে এবারও মশুর, সরিষা এবং রাই জাতের ফসল ফলানো হয়েছে। পদ্মার জেগে উঠা চরের পলি মাটিতে ফলেছে এসব ফসল। এখন কিছু কিছু জমি তৈরী করা হচ্ছে ধানচাষের জন্য। যেসব জমি এখন তৈরী করা হচ্ছে, সেগুলো বাদে অন্য জমিগুলোর কোনো অংশে সবুজের সমারোহ আবার কোনো অংশে সরিষা ও রায় চাষ করায় সেগুলোরে হলুদ ফুলে যেন হলুদ হয়ে আছে।
একই এলাকার সাইফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি বলেন, পদ্মা আর পদ্মা নাই। এখন শুধু বর্ষা মৌসুমেই পদ্মার জৌলুস। এই পদ্মা তার যৌবন হারিয়ে ফেলেছে। বর্ষার সময় মাত্র তিন থেকে চার মাস পদ্মায় পানি দেখা যায়। আর ভরা পদ্মা থেকে আরো কম সময়। এক-দেড় মাস। এই সময়ের পর থেকেই দ্রুত পানি নামতে থাকে। এরপর তিন-চার মাসের মধ্যে পদ্মা একটি মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হয়।
স্থানীয় কৃষক নজরুল ইসলাম জানান, এখন পদ্মায় আর বেশি সময় পানিই থাকে না। গত কয়েক বছরের চেয়ে বেশি জমিতে পলি পড়ে চরের সৃষ্টি হয়েছে। এসব পলিমাটিতে ফসল চাষ হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ জমি চলে গেছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে। পদ্মার পাড়ের এসব স্থানীয় প্রভাবশালী বাসিন্দারা কেউ বাপ-দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি, আবার কেউ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে লিজ নিয়ে এবং কেউ শাহ মখদুম দরগা থেকে লিজ নিয়ে জমিগুলো দখল করেছেন। তবে আদৌ অধিকাংশরই কোনো কাগজপত্র নেই। শুধুমাত্র স্থানীয় প্রভাবশালী হওয়ার কারণে এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তারা এসব জমি দখল করে ফসল ফলাচ্ছেন আবার কেউ বর্গা দিচ্ছেন। যারা ফসল ফলাচ্ছেন, তারাও দিনমজুর ডেকে নিয়ে জমিতে কাজ করাচ্ছেন। আর নিজেরা তদারকি করছেন। কিন্তু আদৌ যারা এই পদ্মার বুকে একসময় ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারাও হচ্ছেন বঞ্চিত।

নগরীর শ্রীরামপুর এলাকার বাসিন্দা ও পদ্মার পরে ধানচাষকারী চাষি নবীর উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এই চরে দীর্ঘদিন ধরেই ধানচাষ করছি। প্রতিবারই এক জমিতে ধানচাষ করতে পারি না। দুই-চার বছর একই জমিতে ধানচাষ করা গেলেও পরের বছর দেখা যায় ওই জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। আবার অন্য কোথাও চর জেগেছ। ওই চরে ধানচাষ করতে গেলে তখন প্রভাবশালীরা নিজেদের জমি দাবি করে। বাধ্য হয়ে তাঁদের নিকট থেকেই বর্গা বা লিজ নিয়ে ধানচাষ করি।’

বিশিষ্ট পানি গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ভারতের আগ্রাসী পানিনীতি আর এ অঞ্চলের মানুষের কাছে মরণবাঁধ হিসেবে খ্যাত ‘ফারাক্কা ব্যারাজ’ বিগত সাড়ে চার দশকে পদ্মা ও তার শাখা-প্রশাখাগুলোর দফা রফা করে ছেড়েছে। একসময়ের অন্যতম নদী হিসাবে পরিচিত পদ্মা এখন বিশাল বালুচরের নিচে চাপা পড়ে হাহাকার করছে। এর শাখা-প্রশাখা নদী বড়াল, মরা বড়াল, নারদ, হোজা, বারনই, মুছাখান, ইছামতি, ধলাই, হুড়াসাগর, চিকনাই, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, বেতা কালিকুমার, হরিহর, কালিগঙ্গা, কাজল, হিসনা, সাগরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ, বেলাবত এদের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন।

স/শা