রাজশাহীর ফটোসাংবাদিক প্রিন্স রশীদ’র মৃত্যু দিন আজ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: কথায় বলে, ‘একটা ছবি হাজার শব্দের কথা বলে’। ছবি একটি স্থির সময়ের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই ছবিই হয়ে ওঠে ইতিহাস। যখন একজন দক্ষ কারিগর কোনো একটা সময়কে, মানুষের অভিব্যক্তিকে শিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে দেশের প্রথিতযশা আলোকচিত্র শিল্পী রশিদ তালুকদার নিজ হাতে রচনা করে গেছেন এ রকম অসংখ্য ইতিহাস। কর্মেই যার পরিচয়। তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ।

যুদ্ধ সাংবাদিকদের কলম যুদ্ধের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব নিয়ে লড়ে যান ক্যামেরা যোদ্ধারাও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সফল ক্যামেরা যোদ্ধা তিনি। তার ক্যামেরায় বন্দী হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বহু সাক্ষী-প্রমাণ। এদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠলেই রশিদ তালুকদারের নাম উঠে আসে সবার আগে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছবি তুলেছেন শুধু দেশের জন্য।

১৯৬৯ সাল থেকে শুরু করে আজীবন তিনি ক্যামেরায় দেশ ও জাতির ইতিহাসকে ধারণ করেছেন। ক্যামেরার ফ্রেমে তিনি বন্দি করেছেন অনেক ইতিহাস, বাস্তবতা, মানবতা। ছবি দিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন অনেক সত্যকে। তার ছবি বলেছে অনেক নির্যাতিতদের অব্যক্ত কথা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিত্রগুলোই তার হাতে তোলা। তার তোলা ছবিগুলোতেই আমরা মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন দৃশ্য দেখি। তার তোলা ছবি দেশ-বিদেশের অনেকের কাছে পরিচিত। তার ক্যামেরায় তোলা আছে বিভিন্ন মুহূর্তের অনেক বিরল ছবি।

আলোকচিত্র শিল্পী রশীদ তালুকদার ১৯৩৯ সালের ২৪শে অক্টোবর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের চব্বিশ পরগণায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবদুল করিম তালুকদার ছিলেন চাকুরীজীবি এবং মা রহিমা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। বাবা স্টেশন মাস্টার হওয়ায় পৈত্রিক ভিটা মাদারীপুরের কালকীনি থানার দক্ষিণ রমজানপুর গ্রামের পরিবর্তে তার জন্ম হয় চব্বিশ পরগণায়। ১৯৫৭ সালে তার বাবা আবার বদলী হয়ে খুলনা থেকে রাজশাহী চলে আসেন।

পড়াশুনার পাট চুকিয়ে পেশা হিসেবে ফটো সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছিলেন রশীদ তালুকদার। কর্মজী্বনে ১৯৫৯ সালে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে পিআইডি বা প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টে ৮০ টাকা বেতনে যোগ দেন। এর পর ১৯৬২ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ফটো সাংবাদিক বা আলোকচিত্রী হিসেবে যোগদান করেন। ফটো সাংবাদিক হিসেবে তাঁকে জীবনের প্রথম অ্যাসাইনমেন্টটি দিয়েছিলেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি শহীদুল্লাহ কায়সার। ১৯৭১ সালে পেশাগত জীবন থেকে কিছুটা দূরে সরে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিশে যান তিনি। নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতে শুরু করেন বীরসেনানীদেরকে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে রশীদ তালুকদার দৈনিক সংবাদ থেকে চলে এসে যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। সেখানে তাঁর সহকর্মী হিসেবে ছিলেন ইত্তেফাকের সাবেক সম্পাদক রাহাত খান। দৈনিক ইত্তেফাকে তিনি একাধারে ২৯ বছর চাকরি করে ২০০৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, রশীদ তালুকদার ছিলেন বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

বীর বাঙালীদের স্বাধিকারের দাবিতে স্বাধীনতা-পূর্ব ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের স্থিরচিত্র ধারণ করে নিজেকে স্মরণীয় করে রেখেছেন রশীদ তালুকদার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণ-অভ্যুত্থানের স্থির চিত্র হিসেবে মিছিলের সম্মুখভাগে টোকাই বা পথশিশুর ছবি তুলে সকলের নজর কাড়েন তিনি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণ-অভ্যুত্থানের স্থির চিত্র হিসেবে মিছিলের সম্মুখভাগে টোকাই বা পথশিশুর ছবি তুলে সকলের নজর কাড়েন তিনি। ছাত্রদের অসহযোগ আন্দোলনে শহীদ আসাদের মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন রশীদ তালুকদার। তার ক্যামেরায় স্থিরচিত্র হিসেবে ফুঁটে উঠেছিল ছাত্র-জনতার দীর্ঘ মিছিলসহ আসাদের শার্টের ছবি। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের অসহযোগ আন্দোলনকেও ক্যামেরায় ধারণ করেন রশীদ তালুকদার। পরবর্তীতে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে বুদ্ধিজীবীদের লাশ উত্তোলনের ছবিও তিনিই ধারণ করেন।

বাংলাদেশের বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে তার আলোকচিত্র। রশিদ তালুকদারের বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, বাংলাদেশে আসা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মাদার তেরেসার ছবি, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম, বুদ্ধিজীবিদের লাশ উত্তোলনের স্থিরচিত্র ধারণ করে রশীদ তালুকদার স্মরণীয় হয়ে আছেন।

আলোক চিত্রকলায় অসামান্য অবদানের জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে স্বর্ণপদকসহ প্রায় ৭৭টি পুরস্কার লাভ করেন রশীদ তালুকদার। এর মধ্যে ২০০৬ সালে তাকে ‘ছবি মেলা আজীবন সম্মাননা পুরস্কার’, ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অলাভজনক বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি’র পক্ষ থেকে ‘পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড’, জাতিসংঘ কর্তৃক ‘নিরাশ্রয়ের জন্য আশ্রয়’ শীর্ষক প্রতিযোগিতায় একত্রে ৬টি পুরস্কার এবং জাপান ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ও আসাহি সিমবুন পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় পরপর দুইবার পুরস্কৃত হওয়া অন্যতম।

রশীদ তালুকদারের ডাক নাম কাঞ্চন এবং সহকর্মীদের কাছে তিনি ‘রশীদ ভাই’ নামে পরিচিত ছিলেন। যৌবনে রাজশাহীতে পরিচিত ছিলেন ‘প্রিন্স রশীদ’ নামে। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এই আলোকচিত্র শিল্পীর আজ ষষ্ট মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১১ সালের আজকের দিনে (২৫ অক্টোবর) তিনি ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। প্রথিতযশা আলোকচিত্রশিল্পী রশীদ তালুকদারের মৃত্যু দিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

সূত্র: রাইজিংবিডি