রাজশাহীর পদ্মা পাড়জুড়ে দখলের মহোৎসব

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

প্রমত্তা পদ্মার বুকজুড়ে এখন ধুধু বালুচার। একদিকে ভারতের নদী সন্ত্রাস আরেকদিকে দেশীয় দখলবাজদের দাপটে পদ্মা যেন তাঁর শ্রী হারিয়ে ফেলেছে। ধূকছে পদ্মা। বর্ষার মাত্র দুই-তিন মাস পদ্মায় পানি থাকে টলমল। এর মধ্যে মাস খানেক থাকে ভরা পদ্মা। এরপর জৌলুস হারাতে থাকে। যৌবন হারিয়ে ক্রমেই পদ্মা সুষ্ক মৌসুমে যেন মরুভূমিতে পরিণত হয়। এবারো তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি। ক্ষয়িষ্নু পদ্মাকে ঘিরে এবারো দখলবাজরা যেন মহোৎসবে নেমেছে। গোটা রাজশাহীজুড়েই পদ্মাঘিরে চলছে এই দখলবাজি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও নদীর মাঝখানে একেবারে বাঁধ দিয়ে চলছে বালু উত্তোলন, আবার কোথাও পিলার, কোথাও পাকা ভবন, কোথাও বাঁশ-খাম্বা দিয়ে স্থাপনা গড়ে তুলে দখল করা হয়েছে রাজশাহীর পদ্মার পাড়। দখলের রাজত্বে পদ্মা কোথাও কোথাও এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে। কোনো মতে গড়িয়ে যাচ্ছে পানি। আবার কোথাও অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে গভীরতায় ভাঙছে তীর। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তার পরেও হুমকিরমুখে থাকা পাড় রক্ষায় ভরা বর্ষায় ফেলা হয় কোটি কোটি টাকার জিওবি ব্যাগ। কিন্তু তাতেও রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে শহররক্ষা বাঁধ। এ অবস্থায় গোট বর্ষা মৌসুমে অনেকটা নির্ঘুম কাটাতে হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। হুমকিতে থাকেন শহরবাসীও। অন্যদিকে পদ্মায় পানি প্রবাহ সুষ্কমৌসুমে একেবারে তলানিতে নামায় হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ। মাছ শিকার করতে না পারায় পদ্মা পাড়ের জেলেরা এখন অনাহারে-অর্ধাহারে কাটাচ্ছেন জীবন। কিন্তু এতোকিছুর পরেও পদ্মায় দখলের মহোৎসব থামেনি। উল্টো দেশজুড়ে যখন নদী রক্ষায় শুরু হয়েছে উচ্ছেদ অভিযান, ঠিক ওই সময়ই রাজশাহীর পদ্মায় একেবারে মাঝখানে বাঁধ দিয়ে বালু উত্তোলনের মহাযজ্ঞে নেমেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল আলম বেন্টু।

রাজশাহীর তালাইমারী এলাকায় প্রশাসনের বাধা উপেক্ষা করে এই বেন্টু অবৈধভাবে বালুঘাট গড়ে তুলে এমনিতেই শহররক্ষা বাঁধ ফেলেছেন হুমকিরমুখে। এ নিয়ে গত বছরের ১৭ মার্চ কালের কণ্ঠে একটি খবর প্রকাশের পর উচ্চ আদালতে রিট করেন আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তি। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত ২৪ জুলাই রাজশাহী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান চালিয়ে বালুঘাটটি বন্ধ করে দিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। কিন্তু কয়েকদিন পরে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে ওই ঘাট দিয়েই আবারো বালু উত্তোলন করতে শুরু করেন ক্ষমতাধর আজিজুল আলম বেন্টু।

অভিযোগ রয়েছে, এই বেন্টু বালুঘাটের নামে শহরজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে গত কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন। আর সেই টাকার জোরে তিনি প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এখন খোদ পদ্মার মাঝখানে বাঁধ দিয়ে বালু উত্তোলনের মহাযজ্ঞ চালাচ্ছেন।

গতকাল বেন্টুর এই অবৈধ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, গত কয়েকদিন ধরে গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলেও বেন্টুর বালুর ট্রাকগুলো দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে। বেন্টুর নির্দেশ পেলেই আবারো যে কেনো সময় বালুর ট্রাকগুলো পদ্মায় ঢুকে পড়ে বালু উত্তোলন করে শহর দাঁপিয়ে বেড়াবে। বেন্টুর এই বালুর ট্রাকের ধাক্কায় গত কয়েক বছরে রাজশাহী নগরীর বেশ কয়েকজনের প্রাণহানীর ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু থামেনি তাঁর দাপট।
অন্যদিকে বেন্টুর পাশাপাশি নগরীর বুলনপুরে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজব আলীর নেতৃত্বে চলছে বালু সন্ত্রাস। এই এলাকায় বাস্তবায়ন কয়েকশত কোটি টাকা ব্যয়ের মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক। পদ্মা নদীর তীরেই এই প্রকল্পটির নিচ থেকেই গত কয়েক বছর ধরে বালু উত্তোলন করছেন আওয়ামী লীগ নেতা রজব আলী। এতে করে বড় এই উন্নয়ন প্রকল্পটিও পড়েছে হুমকিরমুখে। কিন্তু রজব আলীর দাপটের কারণে কারণে এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।

তবে রজব আলী দাবি করেন, তাঁর বালুমহালটি লিজ নেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক থেকে দূরে। সেখান থেকেই তিনি বালু উত্তোলন করছেন।

এদিকে নগরীর শ্রীরামপুরে খোদ প্রশাসনের উদ্যোগে নদী দখল করে গড়ে তুলা হয়েছে পাকা ভবন। আবার সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে পদ্মার তীর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে নানা স্থাপনা। সেইসঙ্গে স্থানীয় ব্যক্তিরাও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ নানা ধরনের স্থাপনা গড়ে তুলেছেন বড়কুঠি এলাকায়।

নগরীর শেখেরচক এলাকার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এই পদ্মা ছিল যৌবনে ভরা। আজ সে মৃতপ্রায় একটি নদী। সেই নদীকে আরো দিনের পর দিন মৃত বানিয়ে ফেলছে দখলদাররা। যে যার মতো দখল করে চলেছে নদী এবং নদীর তীর। আগে তীর দখল হতে দেখেছে। এখন দেখছে নদীর ভিতর দখর করেও গড়ে তোলা হচ্ছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এদের থামাবে কে?’

অন্যদিকে রাজশাহীর বাঘার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের গোকুলপুর ও কিশোরপুরে পদ্মার তীরঘেঁষে বালু উত্তোলনের কারণে তীর ভাঙ্গনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাবাসী গত ১৮ ডিসেম্বর মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী।
স্থানীয় ইউনিয় পরিষদের চেয়ারম্যান মেরাজ উদ্দিন বলেন, ‘জাতীয় পার্টির নেতা রেন্টু সরকারের নেতৃত্বে এই বালুঘাট দিয়ে অবাধে বালু উত্তোলনের কারণে শতশত এলাকাবাসীর ঘরবাড়ি বিলিন হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভও রয়েছে। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’

রাজশাহীর পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মাহবুব টুংকু বলেন, ‘নদীর মধ্যে রাস্তা নির্মাণ করে নদীর পাড় দখল করে নদীকে ধ্বংস করার ক্ষমতা সরকার কাউকে দেয়নি। তার পরেও প্রভাবশালীদের াপটে পদ্মা আজ ধূঁকছে। এটি মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু প্রশাসন এদিকে কোনো নজর দিচ্ছে না রহস্যজনক কারণে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়।’

এদিকে নদী দখল উচ্ছেদ অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক হামিদুল হক বলেন, ‘পদ্মা দখল উচ্ছেদ অভিযানও দ্রুত শুরু হবে। একটু শীত কমলেই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।’