রাজশাহীর জীবন্ত ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেনের সেকাল-একাল

নিজস্ব প্রতিবেদক:
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরই পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা নিয়ে শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র। এরপর ১৯৪৮ সালেই সারাদেশে ভাষার দাবিতে আন্দোলন ত্বরান্বিত হতে থাকে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মাঠে নামে বাঙালিরা। ওই বছরের ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে প্রথম রক্ত ঝরে রাজশাহীতেই।

এরপর ভাষা শহিদদের স্মরণে রাজশাহীতেই গড়ে উঠে প্রথম শহীদ মিনার। এ আন্দোলনে রাজশাহী থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী তাদের একজন। সেই ৪৮’র যুবক এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তবে থেমে নাই তার পথচলা। এই বয়সে এসেও তিনি তাঁর ব্যবসা ধরে রেখেছেন। সংসারজীবনটাকে আগলে রেখেছেন নিজ হাতে। যার কারণে এখনো তিনি রাজশাহী নগরীর আরডিএ মার্কেট এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এক নম্বর গদি ঘর দোকানে ব্যবসা ব্যবসা পরিচালনা করেন এই প্রবীণ ভাষাসৈনিক।

রাজশাহীর যে ক’জন ভাষাসৈনিক জীবিত আছেন মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী তাদের একজন। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আজকের আয়োজনে এ সৈনিকের শিক্ষাজীবন, রাজনৈতিক জীবন, বৈবাহিক জীবন ও কর্ম জীবন সম্পর্কে জানবো-

ছোট থেকেই ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী ছিলেন রাজনীতি ও সমাজ সচেতন। সমাজের নানা অসঙ্গতিতে ছিলেন সোচ্চার। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন তিনি। সে সময় রাজশাহী নগরীর লোকনাথ স্কুলে পড়তেন তিনি। সমাজ সম্পর্কে সচেতন থাকার কারণে দেশব্যাপী ভাষা আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাজশাহী থেকে সোচ্চার হন তিনি। সেসময় স্কুলে স্কুলে গিয়ে ছাত্রদেরকে বাংলা ভাষার দাবিতে সচেতন করা, সংগঠিত করতে অন্যদের সাথে কাজ করেছিলেন তিনি। শহরের পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে মানুষকে সচেতন করা, উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে কী পরিণতি হবে তার কুফল সম্পর্কে যে ক’জন সংগ্রাম করেছিলেন তাদের মধ্যে কনিষ্ঠ ছিলেন ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী।

ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীর সর্বস্তরের পেশাজীবী ছাত্র-জনতার গৌরবময় ভূমিকা ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে এখনো। ঢাকার পরেই ভাষা আন্দোলনের পুরো সময়টা রাজশাহী উত্তাল ছিল ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে রাজশাহীতে গঠিত হয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ওই পরিষদের সভাপতি ছিলেন রাজশাহী মেডিক্যাল স্কুলের ছাত্র এস এম গাফ্ফার এবং যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন রাজশাহী কলেজের জ্যেষ্ঠ ছাত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোলাম আরিফ টিপু (বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর) ও নাটোরের হাবিবুর রহমান। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনে আরো যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের ছিলেন মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি, আব্দুর রাজ্জাক, মনোয়ারা বেগম, আবুল হোসেন ও সাইদউদ্দিন আহমেদ।

এই ভাষাসৈনিকদের প্রত্যেকেই বিভিন্ন সময় দাবি করেছেন, রাজশাহীর ভাষাসৈনিকরাই ভাষাশহীদদের স্মরণে রাজশাহীতেই দেশের প্রথম শহীদ মিনারটি তৈরি করেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী কলেজের মুসলিম হোস্টেলের সামনে ইট ও কাদামাটি দিয়ে তৈরী করা হয়েছিলে ভাষাশহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার।

রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় নেতাকর্মীরা এখনো যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের একটাই দাবি- দেশের মধ্যে এটিই প্রথম শহীদ মিনার। এর জন্য তারা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিরও দাবি জানান।
সেই দিনের স্মৃতিকথা:

ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীতে সক্রিয় থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি তাঁর ভাষায়, ‘ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন রাজশাহী কলেজের ছাত্র। ভাষা আন্দোলনের সে দিনের দিনগুলোর কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি জানান এভাবে, ‘ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীর সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা ১৯৪৮ সাল থেকেই সক্রিয় ছিল। ওই সময় থেকেই যে কোনো আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল রাজশাহী কলেজ। আমরা ভাষা আন্দোলনে ঢাকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে তাল রেখে রাজশাহীতে আন্দোলন-সংগ্রাম কর্মসূচি পালন করতাম। ১৯৪৮ সালে রাজশাহী নগরীর ফায়ার বিগ্রেড মোড়ে ছাত্র জনতার মিছিলে তৎকালীন মুসলিগের ক্যাডাররা ও পুলিশ হামলা করে। এতে একজন রক্তপাতও হোন। এর পর থেকেই রাজশাহীর ছাত্রজনতা আন্দোলন অব্যাহত রাখে।’

মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি বলেন, ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় ভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আমরাও রাজশাহীতে ভাষার দাবিতে আন্দোলন করছি। ২১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে আমরা দিনভর ঢাকার খবর জানার জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। কারণ, রাজশাহীর ছাত্রদের মনে গভীর আশঙ্কা ছিল- ঢাকায় বড় কিছু ঘটতে পারে। অবশেষে সন্ধ্যার দিকে রাজশাহীতে খবর এলো- ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি হয়েছে। অনেক ছাত্র আহত ও নিহত হয়েছেন। ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী শহরে বিষাদের ছায়া নেমে এলো। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল। তখনকার দিনে সব আন্দোলনেই ছাত্রদের জমায়েত হওয়ার স্থান ছিল রাজশাহী কলেজ। সন্ধ্যার কিছুটা পরেই কলেজের নিউ হোস্টেলে একে একে রাজশাহীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা জমতে শুরু করল। একপর্যায়ে কয়েক শ ছাত্র জমায়েত হলো হোস্টেল প্রাঙ্গণে। সবার চোখে-মুখে ভীষণ উৎকণ্ঠা, কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ে সবার কণ্ঠেই উচ্চারিত হচ্ছে, ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ রাজশাহী মেডিক্যাল স্কুলের সিনিয়র ছাত্র এস এম গাফ্ফারের সভাপতিত্বে শুরু হলো ছাত্রদের সভা। সভায় দুটি প্রস্তাব গৃহীত হলো। রাজশাহীতে দুর্বার গতিতে ভাষা আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন ও শহীদ ছাত্রদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ করা। এরপর ওই রাতেই ইট ও কাদামাটি দিয়ে শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হলো। সেটি রাত জেগে পাহারাও দেওয়া হলো। কিন্তু সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম লীগের সন্ত্রাসীরা ও পুলিশ এসে শহীদ মিনারটি ভেঙে দিল।

মোশাররফ হোসেনের শিক্ষাজীবন:
মাধ্যমিকের গণ্ডি না পেরোতেই ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। নগরীর লোকনাথ স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পর ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। এখান থেকে পড়াশোনা শেষ হয়। পরে ভর্তি হন নীলফামারি ডিগ্রী কলেজে। সেখান থেকে শিক্ষাজীবন শেষ হয় তাঁর। মাধ্যমিকের পর থেকেই রাজনীতির সাথে যুক্ত হন।
রাজনৈতিক জীবন:
সমাজসচেতন ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী শিক্ষাজীবনেই রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়তে তখন থেকেই কাজ করেন তিনি। শিক্ষাজীবনে ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সকল কার্যক্রমে ছিলেন সামনের সারিতে। মুখোমুখি আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ‘ছোটো থেকেই দেশের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখতাম। নানা অসঙ্গতিতে সোচ্চার ছিলাম সবসময়। তখন থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হই। একপর্যায়ে যুক্ত হই ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে। প্রকাশ্যেই সেসময় কমিউনিস্ট পািির্ট করতাম। সেসময় থেকেই বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী। এখনো সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি’
তখন থেকেই দেশ-জাতির কল্যাণে যেকোনো গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। এখনো দেশের কোনো অসঙ্গতি দেখলে রাজশাহী থেকে মুখ খুলেন তিনি।

বৈবাহিক জীবন:
শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার কিছুদিনের মাথায় বিয়ে করেন ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। ঘরে আসে দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম কলেজে উপাধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত আছেন। ছোট মেয়ে আগে চাকরি করতেন। তবে এখন গৃহিণী। আর একমাত্র ছেলে রাজশাহী নগরীর সাহেব বাজার আরডিএ মার্কেটের বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী পৌনে দু’শ বছরের দোকানে কাজ করছেন। সবমিলিয়ে বেশ ভালোই কাটছে তার বর্তমান জীবন।

কর্মজীবন:
শিক্ষাজীবন শেষে বৈবাহিক জীবনে পা দেন জীবন্ত ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। এর কিছুদিনের মধ্যে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে চাকরিও শুরু করেন তিনি। এখন বসছেন বাপ-দাদার দেয়া নগরীর সাহেব বাজারের আরডিএ মার্কেটের ঐতিহ্যবাহী ‘মেসার্স ১ নম্বর গদী’ নামের একটি মুদির দোকানে। ছেলের পাশে এভাবেই কাটছে তাঁর দিনকাল। বিভিন্ন কাজের ফাঁকে এখানে নিয়মিত বসেন তিনি। বসে অনেক সময় পড়ালেখা করেন। দেশকে নিয়ে ভাবছেন প্রতিনিয়ত। পাশাপাশি বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন এখনো।

যেমন যাচ্ছে দিনকাল:
রাজশাহী থেকে ভাষার দাবিতে সংগঠক ও নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে এখনো বেঁচে আছেন তিনি। এছাড়া আরো কয়েকজন বেঁচে আছেন। কিন্তু বয়সের ভারে স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা ঘিরে ধরেছে তাঁকে। তার পরেও সময়-সুযোগ করেই এখনো বাপ-দাদার রেখে যাওয়া দোকানে বসে ব্যবসা পরিচালনা করেন। আবার নিয়মিত পত্রিকাও পড়েন। সংসারে সময় দেন নাতি-নাতনীদের সঙ্গে। ভাষা আন্দোলনকারী অন্যদের কথা জানতে চাইলে স্মৃতি হাতড়ে কেবল একজনের কথাই বলতে বললেন মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। আর তিনি হলেন, ভাষাসৈনিক এ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু এবার একুশে পদক পেতে যাচ্ছেন। ক’দিন আগেই তার নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এতে বেশ খুশি ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। কিন্তু তবুও বেশ অসম্পূর্ণতা নিয়ে দিন যাপন করছেন তিনি। এ অসম্পূর্ণতা সংসারের কিংবা ব্যক্তিগত বিলাসিতার নয়। এ অসম্পূর্ণতা দেশের কল্যাণের। দেশের মানুষের প্রতি। ভাষার পরিপূর্ণতার।

তিনি বলেন, ‘আমরা যে উদ্দেশ্যে ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। তার কতটুকু পেয়েছি। এখনো উচ্চ আদালতের রায় ইংরেজিতে বের হয়। সারাদেশে বিলবোর্ড-ব্যানারে ইংরেজিতে ভর্তি। এগুলো যখন বাংলা হবে তখন পূর্ণতা হবে। তবে ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে বাংলার নিচে থাকতেই পারে।’
জীবন্ত এ ভাষাসৈনিকরা চান দেশের অসাম্প্রদায়িকতা। চান যে জন্য তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন তার পূর্ণতা। তাহলেই তারা থাকবেন খুশি।

স/র