রাজশাহীতে সোনালী ব্যাংকের কোটিপতি মালির দাপট!

নিজস্ব প্রতিবেদক:

তাঁর পদমর্যদা মালি বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। কিন্তু তাতে কী? তিনি সোনালী ব্যাংক শ্রমিক ইউনিয়ন রাজশাহী শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহাজার আলী। রাজশাহী মহানগর শ্রমিক লীগের যুগ্ম সম্পাদকও তিনি। আর তাতেই তাঁর দাপট যেন সোনালী ব্যাংক রাজশাহীজুড়ে। তাঁর কর্মস্থল প্রিন্সিপাল শাখায়। কিন্তু শ্রমিক ইউনিয়ন এবং শ্রমিকলীগের নেতা হওয়ায় তিনি নিয়মিত অফিসও করেন না।

উল্টো বিভিন্ন পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি, লাঞ্চভাতা থেকে সপ্তাহে দুই শ টাকা করে কমিশন আদায়, ঋণের তদবিরসহ নানা অনিয়মে জড়িত মোজাহার আলী। সর্বশেষ সোনালী ব্যাংক রাজশাহী প্রিন্সিপাল শাখা থেকে চলমান স্টাফ হাউজিং লোনের ৩০ কোটি টাকার মধ্যে সেই মোজাহার আলীর সুপারিশেই দিতে হয়েছে অন্তত সাত কোটি টাকা। বিনিময়ে ঋণপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিকট থেকে একপ্রকার জোর করেই তিনি এক-দেড় লাখ টাকা হারে কমিশন আদায় করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অভিযোগ উঠেছে, একজন মালি পদে চাকরি করেও এভাবে নানা অনিয়মের মাধ্যমেই মোজাহার আলী এখন কোটিপতি। রাজশাহী নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় কিনেছেন প্রায় কোটি টাকা মূল্যে জমি। এছাড়াও জেলার বাঘা-চারঘাটে তাঁর রয়েছে অন্তত ১০টি আমবাগান। এর বাইরেও নগরীর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তাঁর জমি।

সোনালী ব্যাংকের একাধিক সূত্র সিল্কসিটি নিউজকে জানায়, স্টাফ হাউজ বিল্ডিং লোনের আওতায় গত জুলাই মাসে সোনালী ব্যাংক রাজশাহী প্রিন্সিপাল শাখার আওতায় সর্বমোট ৩০ কোটি টাকা লোন বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই বরাদ্দের বিপরীতে লোন প্রত্যাশী আবেদনকারী কর্মকর্তাদের প্রায় ৭০ জনের একটি তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু সেই তালিকার মধ্যে অন্তত ২৫ জনের নাম দেওয়া হয় প্রিন্সিপাল শাখায় মালি পদে কর্মরত শ্রমিক নেতা মোজাহার আলীর সুপারিশে।

তার সুপারিশকৃত তালিকা অনুযায়ী ওইসব কর্মকর্তাদেরই দিতে হয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা। আর বাকি টাকা দিতে হয়েছে সুপারিশের বাইরের কর্মকর্তাদের। ফলে আবেদন করেও সুপারিশ না থাকায় অনেকেই লোন পাননি। আবার যারা শ্রমিক নেতা মোজাহার আলীর নিকট থেকে সুপারিশের মাধ্যমে লোন পাচ্ছেন-তাঁদের এখন দিতে হচ্ছে ঘুষ।

সূত্রগুলো আরও জানায়, মোজাহার আলী নিজেই লোনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ফোন দিয়ে ডেকে নিয়ে তাঁদের নিকট থেকে টাকা আদায় করছেন। অনেকটা জিম্মি হয়েই টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছেন শ্রমিক নেতা মোজাহার আলীকে।

জানতে চাইলে রাজশাহীর একটি শাখায় কর্মরত একজন সিনিয়র অফিসার বলেন, ‘আমি সুপারিশ করে নিতে পারিনি বলে লোন হয়নি। শ্রনেছি শ্রমিক নেতা মোজাহারের যাঁদের জন্য সুপারিশ করেছেন, তাদের অধিকাংশরই ঋণ হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু আমি ৬৬ লাখ টাকা ঋণের জন্য আবেদন করে পাইনি।’

আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ‘চা-নাস্তা খেতে কিছু দিয়েছে। তবে কতো দিয়েছে বলা যাবে না। খুশি হয়ে এটা করেছি। তিনি (মোজাহার আলী) পরিশ্রম করেছেন। তাই তাঁকে খুশি করতে হয়েছে।’

অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘টাকা না দিলে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে। ফলে বাধ্য হয়েই টাকা দিতে হয়েছে তাঁকে।

নাম প্রকাশে একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘স্টাফ হাউজ বিল্ডিং লোনের বিপরীতে মুঞ্জরিপত্র হওয়ার পরে শ্রমিক নেতা মোজাহার আলীকে দিতে হয়েছে দেড় লাখ টাকা।’

এদিকে সোনালী ব্যাংকের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শহরের বাইরে বদলি করলেও শ্রমিক নেতা মোজাহার আলী তাঁর হয়ে প্রভাব বিস্তার করেন। এরপর ওই কর্মকর্তাতে পুনরায় শহরে বদলি করে আনতে হয়। এই বদলি বাণিজ্য করেও তিনি বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিপরীতে শহরের বাইরে উপজেলা শাখাগুলোতে কর্মকর্তা-কর্মচারী সঙ্কট লেগেই থাকে। অথচ শহরের শাখাগুলোতে অতিরিক্ত জনবলের কারণে অনেকই বসে থেকে সময় কাটান। এ নিয়ে সোনালী ব্যাংক রাজশাহী শাখায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। অতি সম্প্রতি একজন কর্মকর্তার বদলি নিয়ে এবং সেটি বাতিলের তদবির নিয়ে শ্রমিক নেতা মোজাহার আলী প্রিন্সিপাল শাখায় ব্যাপক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি করেন।

আবার কর্মকর্তাদের নামে বরাদ্দকৃত সপ্তাহে এক হাজার টাকা লাঞ্চভাতা থেকেও ২০০ টাকা করে কমিশনা আদায় করেন মোজাহার আলী। দলীয় এবং কর্মচারী ইউনিয়নের বিভিন্ন কর্মসূচির নামে ওই টাকা জোর করে আদায় করেন তিনি। এতে করেও তার নিকট জিম্মি হয়ে থাকতে হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

এছাড়া মোজাহার আলী ব্যক্তি পর্যায়েও কখনো কখনো ঋণ অনুমোদনের তদবির করে থাকেন বলেও নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। এসবের মাধ্যমে তিনি সাধারণত একজন মালি হয়েও গত কয়েক বছরে গড়েছেন অগাধ সম্পদ। এর মধ্যে নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় তিনি প্রায় কোটি টাকা ব্যায়ে কয়েক বিঘা জমি কিনেছেন। এর বাইরে বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তাঁর নামে-বেনামে নানা সম্পদ।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মোজাহার আলী। গত রবিবার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি  বলেন, ‘ভাই আমরা রাজনীতি করি। তাই আমাদের বিরুদ্ধে কেউ মিথ্যা প্রচার করছে। তবে আমি লোন অনুমোদনের জন্য কারো নিকট থেকে টাকা আদায় করিনি। এটা মোটেও সঠিক নয়। আমার কোটি টাকার সম্পদও নাই। বরং আমার লোনের টাকাই শোধ করতে হয়েছে জমি বিক্রি করে।’

অনিয়মিত অফিস করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি কখনোই প্রভাব খাটাই না। নিয়মিত অফিস করি। রাজনীতি করতে গিয়ে হয়তো মাঝে মাঝে অফিসে আসা হয় না। তাই বলে অফিস করি না-এটা সঠিক নয়।’

এদিকে স্টাফ হাউজ বিল্ডিং ঋণ নিয়ে মালি ও শ্রমিক নেতা মোজাহার আলীর বাণিজ্য এবং তদবির সম্পর্কে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংক রাজশাহীর অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান বলেন, ‘তিনি বাণিজ্য করেছেন কিনা বলতে পারবো না। এটা আমাদের জানার মধ্যেও পড়ে না। তবে তাঁর কিছু সুপারিশ আমাদের রাখতে হয়েছে। শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা হিসেবে তিনি কিছু সুপারিশ করেছিলেন, সেই তালিকা অনুযায়ী কিছু লোন দিতে হয়েছে।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের স্টাফদের লোনের চাহিদা থাকে ানেক। কিন্তু বরাদ্দ সেই তুলনায় কম পাওয়া যায়। তাই বিতরণ করতে গিয়েও একটু সমস্যায় পড়তে হয়।’

স/আর