রাজশাহীতে সাইবার অপরাধ: ধর্ষণ-ব্ল্যাকমেইলের শিকার নারীরা, যেভাবে প্রতিরোধ করছে পুলিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

ঘটনা-১: রাজশাহী নগরীর এক মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে রুপা (ছদ্দ নাম)। তাঁর সঙ্গে মোবাইল ফোনের ইমোতে পরিচয় অজ্ঞাত এক ব্যক্তির। এর পর ওই ব্যক্তি নিজেকে আমেরিকান প্রবাসী পরিচয় দেন। একপর্যায়ে রুপার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কও গড়ে তুলেন তিনি। প্রতিশ্রুতি দেন বিয়ের পরে রুপাকে আমেরিকা নিয়ে যাবেন। তার জন্য ভিসা পাসপোর্ট করতে টাকার দরকার হবে। অজ্ঞাত ওই ব্যক্তির কথায় বিশ্বাস করে একে একে পর্যায়ক্রমে ১১ লাখ টাকা তুলে দেওয়া তার হাতে। মাঝে পরিচয় গোপন করে ওই ব্যক্তি রুপাকে বিয়েও করেন। শেষে তিনি বুঝতে পারেন তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।

 

আমেরিকান প্রবাসী পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তি মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তাঁকে ধোকা দিয়ে বিয়ে করেছেন। টাকাও হাতিয়ে নিয়েছেন রুপার বাবার নিকট থেকে। কিন্তু তখনো তাঁর আসল পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি রুপা এবং তাঁর পরিবারের লোকজন। শেষে গত ১৯ সেপ্টেম্বর নগরীর পবা থানায় বাদী হয়ে প্রতারণার মামলা করেন রুপা। পরবর্তিতে মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট তদন্ত নেমে ওই প্রতারকের আসল পরিচয় নিশ্চিত হয়। ততক্ষণে সে আত্মগোপনে চলে যায়। তবে তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ চেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রতারক হলো-মাদারিপুর জেলার কালকিনি উপজেলার এক যুবক।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু এই ঘটনাটিই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহীতে ব্যাপক হারে বেড়েছে এই ধরনের সাইবার অপরাধের ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, ব্ল্যাকমেইল, ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা, মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণা করে বিয়ে করাসহ  নানা ধরনের সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। তবে এই অপরাধগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটছে নারীদের প্রতারিত হওয়ার ঘটনা-এমনটিই পুলিশ নিশ্চিত করেছে। গত কয়েকদিনে মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট অন্তত ৫০টি অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে। তবে মহানগর পুলিশ সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলেও নিশ্চিত করেছে।

ঘটনা-২: মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের দেওয়া তথ্য মতে, রাজশাহীর একটি কলেজে পড়ুয়া বিথী (ছদ্দ নাম) নামের এক ছাত্রীকে তাঁর ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে সানজিদা ইসলাম নামের একটি আইডি থেকে পরিচয় ঘটে এক মেয়ের। এরপর তদের মধ্যে মোবাইল নম্বর আদান-প্রদানও হয়। কিন্তু পরবর্তিতে ওই আইডিটি থেকে অজ্ঞাত একটি ছেলে বিথীর কাছে তাঁর দুই বান্ধবির মোবাইল নম্বর চায়। বিথী তাতে রাজি না হওয়া তার ফেসবুকের ছবির সঙ্গে অশ্লীল ছবি জুড়িয়ে দেওয়া ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করে। শেষে এ ঘটনায় নগরীর কাটাখালি থানায় একটি জিডির সূত্র ধরে সাইবার ক্রাইম ইউনিট ওই অজ্ঞাত প্রতারককে চিহ্নিত করে।

ঘটনা-৩: জাল কাগজে বিয়ে করে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে এবং সেই আপত্তিকর ছবি তুলে ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়ে আবারও ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করা হয় রাজশাহীর বরেন্দ্র কলেজের এক ছাত্রীকে। অসহায় ওই ভিকটিম শেষ পর্যন্ত নগর পুলিশের দ্বারস্থ হলে প্রতারক যুবকের নিকট থেকে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরা অন্তরঙ্গ ছবিগুলো উদ্ধারসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

জানা যায়, একাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া ওই ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেন নগরীর শালবাগান এলাকার সানি আহমেদ নামের এক যুবক। কিছুদিন পরে মেয়েটিকে বিয়েও করেন ওই যুবক। এর পর বিবাহিত বউকে নিয়ে কখনো কক্সবাজার, কখনো রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে গিয়ে যৌন সম্পর্ক করেন সানি। সেই সময় বেশকিছু অন্তরঙ্গ ছবিও তুলেন দু’জনে। একপর্যায়ে মেয়েটি জানতে পারেন ছেলেটির আগের স্ত্রী রয়েছে। কিন্তু সেই তথ্য গোপন করে ওই কলেজছাত্রীকে বিয়ে করেন সানি। এমনকি বিয়ের কাগজপত্রও আসল নয়। নকল কাগজে বিয়ে করা হয় ওই ছাত্রীকে। পরবর্তিতে ওই ছাত্রী যখন সানির নিকট থেকে সরে আসতে চান, তখন তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিগুলো দেওয়া হয় তার ম্যাসেঞ্জারে। যৌন সম্পর্ক না রাখলে সেই ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিসহ আবারো নানাভাবে ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করা হয় ওই ছাত্রীকে। শেষে নগরীর বোয়ালিয়া থানায় মামলা করা হলে সাইবার ক্রাইম ইউনিট সানির নিকট থেকে সেই ছবিগুলো উদ্ধার করে। গ্রেপ্তার করা হয় সানিকে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নারীর সঙ্গে প্রতারণার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে স্বীকার করে রাজশাহী মহানগর পুলিশের সাইবার ইউনিটের প্রধান উৎপল কুমার চৌধুরি। তিনি বলেন, ‘সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে এমন কিছু ঘটনা ঘটছে যা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু গত ১৭ সেপ্টেম্বর মহানগর পুলিশ কমিশনার স্যারের নির্দেশে সাইবার ক্রাইম ইউনিট গঠনের পর এই ধরনের অপরাধ নিয়ে পুলিশ জোর তৎপরতা শুরু করেছে। আগে মামলা হলেও আসামি চিহ্নিত করা যেত না সহজে। এখন আমরা দ্রুত আসামি চিহ্নিত করে সেই আসামির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারছি। ফলে এই ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এখন জোর ভূমিকা রাখছে।’

স/আর