রাজশাহীতে লিজবিহীন চলছে ৪ ঘাট, বালু লুটে নিচ্ছেন আ.লীগ নেতারা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বালু উত্তোলন নিয়ে গত বছরজুড়ে রাজশাহী আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে ছিল টানটান উত্তেজনা। আবার অবাধে শহররক্ষা বাঁধের নিচ থেকে বালু উত্তোলনের ফলে হুমকীরমুখে পড়েছে বাঁধ। এই অবস্থায় এবার চলতি মৌসুমে নতুন করে নগরীর মধ্যেকার চারটি বালুমহালের একটিও লিজ দেয়নি জেলা প্রশাসন। কিন্তু তাতে কী, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে ঠিকই গত এক মাস ৮ দিন ধরে বালু উত্তোলন করে যাচ্ছেন অবাধে। এতে করে মাসে অন্তত তার ৫ কোটি টাকার বালু লুটে নিচ্ছেন আওয়ামী লীগের ওই নেতারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল আলম বেন্টু, এক নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা রজব আলী এবং একই এলাকার আরেক আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন মিলে গত বছর নগরীর আশপাশে গড়ে ওঠা তিনটি বালুমহাল লিজ নেন। কিন্তু বালু উত্তোলন হতো চারটি ঘাট থেকে। আবার অবাধে নগরীর আশপাশের পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন করার ফলে হুমকীরমুখে পড়ছে শহররক্ষা বাঁধ।

তবে বালু কারবারিরা দাবি করেছেন, তাদের আগের মেয়াদে উত্তোলনকৃত বালুই বিক্রি করছেন তাঁরা। নতুন করে বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলন করছেন না।

 

এদিকে শহররক্ষা বাঁধ হুমকীরমুখে পড়ায় তা নিয়ে নগরীর সচেতন মহলের মাঝেও দেখা দিয়েছে চরম ক্ষোভ। বাঁধ বাঁচাতে আন্দোলনও করেন রাজশাহীর সচেতন মহল। কিন্তু

যে উদ্দেশ্য নিয়ে বালুমহাল লিজ দেয়া হলো না, সেই উদ্দেশ্যটি এখন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। তবে লিজ না নিয়ে ঠিকই কোটি কোটি টাকা পকেটে পুরছেন নেতারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত কয়েক বছর আগেই রাজশাহী নগরীর বুলনপুর, শ্রীরামপুর এলাকায় দুটি গ্রোয়েনে দেখা দিয়েছে ভাঙন। ভাঙন রোধে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে সরকারকে। আরও নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরেও রাজশাহী নগরী রয়েছে হুমকিরমুখে।

 

আবার বালুমহাল দখল নিয়েও রয়েছে এক আওয়ামী লীগ নেতার একচ্ছত্র প্রভাব। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের এক সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি বালুমহাল দখলে রেখেছেন। তাঁকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি প্রশাসন। ফলে এ নিয়ে নগরজুড়ে চরম উত্তেজনাও দেখা দেয়।

এর বাইরে চলতি মেয়াদের আগের আটটি বছরে রাজশাহীর ১১টি বালুমহাল পানির দরে লিজ দিয়ে সরকারের অন্তত শতকোটি টাকা লোকসান করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহী নগরীর আশেপাশে গড়ে তোলা চারটি বালুমহালেই লোপাট করা হয় অন্তত ৫০ কোটি টাকা।

শেষ পর্যন্ত সচ্ছতার মাধ্যমে গত বছর ১১টি বালু মহাল লিজ দিয়ে আয় হয় সরকারের ৩৮ কোটি টাকা। কিন্তু অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে শহররক্ষা বাঁধ পড়ে হুমকীরমুখে।

 

এই অবস্থায় বালুমহাল লিজ দিয়ে গত ৮ বছরে যা রাজস্ব আয় হয়েছে, তার চেয়ে অন্তত ১০ গুন টাকা ব্যয় হয়েছে শহররক্ষা বাঁধ মেরামত করতে। সেইদিক বিবেচনা করে এবং শহরের বাঁধের সৌন্দর্য রক্ষায় চলতি বছর নতুন করে আর কোনো বালুমহাল লিজ দেয়া হয়নি শহরের ভিতরে। কিন্তু তার পরেও থেমে নেই বালুকারবারিদের থাবা। গত বছরের মেয়াদ শেষে হয়েছে গত পহেলা বৈশাখ। কিন্তু এখনো বালু উত্তোলন হচ্ছে নগরীর ভিতরে চলমান চারটি অবৈধ বালুমহাল থেকে।

 

নগরীর হড়গ্রাম এলাকার এক ওয়ার্ড সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কোনা ক্ষমতা বলে এখনো বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলন করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা তা বলতে পারব না। আমরা এ নিয়ে প্রশাসনের কাছে বার বার অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। উল্টো বালু উত্তোলন চলছে।’

একই অবস্থা নগরীর বুলনপুর, তালাইমারী ও শ্যামপুর বালুমহালেও বিরাজ করছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। শ্যামপুর বালুমহাল এলাকার বাসিন্দা আকবর আলী বলেন, লিজের মেয়াদ শেষ হয়েছে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু তার পরেও ঘাট দিয়ে বালু উঠছে। বিক্রি হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে সরকারের। আবার অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে হুমকিরমুখে পড়েছে পদ্মার শহররক্ষা বাঁধ।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে গত বছর বালুমহাল লিজ গ্রহণকারী আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার বালুমহালে গত বছর যে বালু উত্তোলন করা ছিল, সেগুলোই আমরা বিক্রি করছি। নতুন করে নদী থেকে বালু উত্তোলন করছি না।’ একই দাবি করেন আওয়ামী লীগ নেতা রজব আলী এবং আজিজুল আলম বেন্টুর লোকজনও।

তবে নিয়ম অনুযায়ী, মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বালুমহাল থেকে সকল প্রকার স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে ইজারাদারকে। সেই হিসেবে গত বছরের বালু উত্তোলন করা থাকলেও সেগুলো পহেলা বৈশাখের মধ্যেই হয় বিক্রি করে ফেলতে হবে,না হয় সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু সেই নিয়মও ভঙ্গ করা হচ্ছে সে ক্ষেত্রে। ফলে অবৈধভাবেই বালুর কারবার করে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা লিজ ছাড়ায়। অথচ গত বছর নগরীর তিনটি বালুমহাল লিজ হয়েছিল প্রায় ১১ কোটি টাকায়।

 

এর বাইরে তালাইমারীতে একটি বালুমহাল লিজ ছাড়ায় দখল করে বালু উত্তোলন করা হয়েছে বছরজুড়ে। সেই হিসেবে চারটি বালুমহাল থেকে গড়ে সরকার মাসে অন্তত এক কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। আর বালু উত্তোলন হচ্ছে অন্তত ৫ কোটি টাকার। এই টাকা হচ্ছে এখন ভাগ-বাটোয়ারা।

অন্যদিকে এরই মধ্যে চলতি মাসে এই বালুর ট্রাকে এক শ্রমিকের প্রাণ গেছে। পরে ওই শ্রমিকের লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে যায় অন্য শ্রমমিকরা। এছাড়াও সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নেতা আজিজুল আলম বেন্টুর নিয়ন্ত্রণাধীন তালাইমারী বালুমহালে বালু ট্রাকের চাকার নিচে পড়ে গেছে আরও এক শ্রমিকের প্রাণ। এর বাইরে নগরীর লিলি সিনেমা হলের সামনে আরও এক ব্যক্তি মারা গেছেন বালুর ট্রাকের ধাক্কায়। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে এই অবৈধ কারবার।

স/আর