রাজশাহীতে ফুটপাতের দোকানে চাঁদাবাজি, জনভোগান্তি-ঘটছে দুর্ঘটনা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

কোথাও বালুর স্তুপ, কোথাও ইটের খামাল, কোথাও পাথরের স্তুপ, আবার কোথাও রাস্তা বা ফুটপাতের ওপরেই চলছে নির্মাণযজ্ঞ। এর বাইরে যেটুকু ফাঁকা পড়ে আছে, সেখানে গড়ে উঠেছে দোকানপাটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। রাজশাহী নগরীর ব্যস্ততম রেলগেট থেকে সাহেব বাজার রাস্তার দুই ধারের ফুটপাতের চিত্র এটি। আর সাহেব বাজারের আশে-পাশের এলাকার চিত্র তো আরও ভয়ঙ্কর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ফুটপাতের ওপরে এক ধরনের টাইলস বসানো হলেও এ ফুটপাতগুলো ব্যবহারের অনুমতি নেই যেন পথচারীদের। সাহেব বাজারসহ আশে-পাশের সব এলাকার ফুটপাত ব্যবসায়ীদের দখলে। এমনকি দোকানপাটের ভিড়ে যেন ধাপ ফেলানোরও জায়গা পাওয়া যায় না।

অভিযোগ রয়েছে, এই দোকানপাট গড়ে তোলার জন্য প্রতিদিন ২০-৪০ টাকা এবং কোথাও কোথাও মাসিক চাঁদা তুলছেন স্থানীয় মাস্তান বাহিনী ও পুলিশের লোকজন। দোকানপাটের কারণে বাধ্য হয়ে মানুষ ফুটপাত ছেড়ে রাস্তা দিয়ে চলাচল করেন। আর তাতে দুর্ঘটনার কবলেও পড়তে হচ্ছে পথচারীদের।

সর্বশেষ গত ১৩ জানুয়ারি ফুটপাতের নিচ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সাইফুল ইসলাম (৭০) নামের বৃদ্ধ মোটরসাইকেলের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন। নগর ভবনের পশ্চিম পাশ এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। বর্তমানে সাইফুল ইসলাম রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে জীবন-মুত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০ থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নগরীর সাহেব বাজার, সোনাদিঘীর মোড়, নিউমার্কেট এলাকা, আলুপট্টি, লক্ষীপুর, উপশহর নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সবগুলো ফুটপাত দখল করে আছেন ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা। সাজেব বাজারের ফুটপাতগুলো কেউ ফলের দোকান সাজিয়ে, কেউ কাপড়ের দোকান সাজিয়ে, কেউ স্যান্ডেলের দোকান কেউ বা চায়ের দোকান তুলে বসেছেন। পুটপাতে পা ফেলানোর কোনো জায়গা নাই।

ফুটপাত ছেড়ে অটোরিকশার ভিড় ঠেলে পায়ে হেঁটে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কথা হয় নাইমা খাতুন নামের এক তরূণীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা নারী। আমাদের এমনিতেই পথ চলতে নানা বাধা। এর মধ্যে গাড়ির ভিড় ঠেলে চলাচল করতে হচ্ছে। কারণ ফুটপাত ধরে হাঁটার কোনো উপায় নাই। দেখেন না, সবগুলো ফুটপাতে দোকানপাট। হেঁটে যাবেন কি করে। দোকান পাটের ফাঁক দিয়ে ভিড় ঠেলে কিভাবে হেঁটে যাবেন’-পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন নাইমা।

জোহরুল ইসলাম নামের এক ষাটার্দ্ধ ব্যক্তিও ছোট ছোট পায়ে একটি ব্যগ হাতে নিয়ে হাঁটছিলেন সাহেব বাজার আডিএর সামনে দিয়ে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই দেখো বাবা ফুটপাত দিয়ে কিভাবে যাবো? একটু জায়গায় ফাঁকা আছে, নাই। এগুলো দোকানদাররা কিভাবে দখল করে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর দখল করে ব্যবসা করছে। কিন্তু কেউ কিছু বলার নাই। তাহলে পথচারীরা হাঁটবে কোন দিক দিয়ে। ফলে আমাদের মতো বৃদ্ধরাও জীবনের ঝূঁকি নিয়ে রাস্তা দিয়েই হেঁটে চলছি। এভাবে হাঁটতে গিয়ে মাঝে-মধ্যেই অটোরিকশার ধাক্কাও খেতে হয়। তবে বড় কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়নি এখনো।’


ওই এলাকার ব্যবসায়ী একাধিক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মাসে এবং প্রতিদিন টোল দিয়ে এখানে ব্যবসা করতে হয়। একদিন টাকা না দিলেই উৎপাত শুরু হয়। আর স্থানীয় কয়েকটি বাহিনী আছে তারা মাসে একবার হলেও আসবে বিভিন্ন ইস্যুতে টাকা নিতে।’

নগরীর লক্ষীপুর এলাকার মেডিক্যাল মোড় থেকে শুরু করে গোটা লক্ষীপুর মোড় নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। যারা প্রতিদিন ৩০-৪০ টাকা করে উত্তোলন করেন দোকান প্রতি। এরক একটি অংশ যায় লক্ষীপুর পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের কাছেও। এর ফলে ওই এলাকার ফুটপাত জুড়েও গড়ে উঠেছে শত শত দোকানপাট। এখানে বছরের পর বছর ধরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দোকানপাট। মাঝে মধ্যে পুলিশ উচ্ছেদ করলেও একদিন পরেই আবার বসে সেসব দোকানপাট। ফলে লক্ষীপুরের এই ফুটপাত কখনোই সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় স্থায়ী ব্যবসায়ীরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে আগে টাকা তুলতে নেমে পড়ে একটি দল। এই টাকা যায় কোথায়। এটি সবাই জানে। কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না।’

তারা আরও জানান, লক্ষীপুর এলাকায় চাঁদা তোলেন  দুই যুবক। তারা লক্ষীপুর বাজার লিজ নিয়েছেন। কিন্তু লক্ষীপুর বাজার ছেড়ে এসে আসেপাশের ফুটপাতের সব দোকান থেকে চাঁদা তোলেন তারা। এমনকি কম্পানীর গাড়ি দাঁড়ালেও সেগুলো থেকে ৪০-৫০ টাকা আদায় করা হয়। ফলে ফুটপাতে দাঁড়ানোরর জায়গাও থাকে না। এই টাকার ভাগ ফাঁড়ি পুলিশের কাছেও যায়।

নগরীর ভদ্রা এলাকাতেও একই পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। এ মোড়েও ধাপ ফেলানো জায়গা নাই। গড়ে উঠেছে কয়েক শ দোকান। এখান থেকেও প্রতিদিন টাকা তুলে একটি চক্র-জানিয়েছেন ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। তবে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কেউ এ নিয়ে নাম প্রকাশ করতে চাননি।


এদিকে রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের কাদিরগঞ্জ এলাকায় দক্ষিণ পাশের রাস্তার ওপরে কয়েকজন শ্রমিক বালু, সিমেন্ট এবং ইটের খোয়া মিশিয়ে পাশের একটি ভবন নির্মাণের কাজ করছেন। রাস্তার দক্ষিণ পাশের ফুটপাতটিও দখল করে সেখানে রাখা হয়েছে ইট এবং খোয়া। ফলে ওই স্থান দিয়ে হেঁটে যাওয়ায় দুষ্ক‹র হয়ে পড়েছে পথচারীদের।

এদিকে নিউমার্কেট এলাকার পূর্বপাশের ফুটপাতটি দখল করে ফের গড়ে উঠেছে দোকানপাট। কয়েক বছর আগে এখানকার দোকানপাট ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হলেও আবারও স্যান্ডেল ও মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীরা দোকানপাট গড়ে তুলেছেন। এর বিনিময়ে প্রতি মাসে একেকজনকে দেড়-তিন হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের।

এর বাইরে রাজশাহী নগরীর শিরোইল বাসস্ট্যান্ড, শিরোই বটতলা কাঁচা বাজার এলাকা, তেরোখাদিয়া বাজার এমনকি বিসিকি শিল্প নগরীর ফাঁকা জায়গা দখল করেও গড়ে উঠেছে ফলের দোকান, কাপড়ের দোকান, স্যান্ডেলের দোকান, হোটেল এবং চায়ের দোকান। এসব দোকান থেকেও সমানে চাঁদা তুলছে স্থানীয় মাস্তান বাহিনী। আর জনগণের পথ চলাচলে ব্যাপক ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে।

জানতে চাইলে আরএমপি পুলিশের মূখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদার টাকার ভাগ পুলিশ পাই, এটা আমার জানা নাই। এই ধরনের কোনো অভিযোগও আমরা পাইনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিব।’
ফুটপাত দখল সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী নগর সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম বলেন, নানা কারণে ফুটপাত দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না। রাসিকের পক্ষ থেকে বার বার অভিযান করেও ফুটপাতের ওপর নির্মাণসামগ্রি থাকছেই। আবার দোকাপাটও গড়ে উঠছে নতুন নতুন। এর জন্য স্থানীয়রাই দায়ী। এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত।’

স/আর