রাজশাহীতে তারুণ্যের সমাবেশ অনুষ্ঠিত

নিজস্ব প্রতিবেদক:
সমকাল সুহৃদ সমাবেশ ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর যৌথ আয়োজনে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে তারুণ্যের সমাবেশ। ‘সমমর্যাদার সাথে নারীর জীবন পরিবর্তনের এখনই সময়’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে রাজশাহী কলেজ মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকসহ অন্যান্য গুণিজনরা।

সমাজে নারী পুরুষের বৈষম্য দূরকরণে সচেতনা বৃদ্ধি এবং যুবসমাজকে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর করতে আয়োজন করা হয় তারুণ্যের সমাবেশ। মিলনায়তনের চারপাশে দেয়া ব্যানার ফেস্টুনগুলোও জানান দিচ্ছে সমাজে নারীর সম অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি। নারীকে নারী হিসেবে নয় বরং মানুষ হিসেবে বিবেচনার মানসিকতা তৈরিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখতে পারে তরুণরাই। ‘আলোকিত পৃথিবী গড়ি’, ‘মর্যাদায় গড়ি সমতা’, ‘তরুণরা গড়বে সমতার পৃথিবী, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে তারুণ্যের সমাবেশ’ এমন ব্যানার ফেস্টুনও জানান দিচ্ছে সেটারই। আর তার জীবন্ত রুপ দিতেই যেন মঞ্চে আবির্ভাব সুহৃদ সদস্য অন্তরা, আশা ও দোলার। হাতে মঙ্গল প্রদীপ, আর ‘মঙ্গল আলোকে’ গানের সাথে দলীয় নৃত্য যেন সবার মাঝে মঙ্গল আলোকবর্তিতা ছড়িয়ে দেবার প্রয়াস।

তরুণদের উদ্দেশ্যে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেন, ‘সমাজের চেহারা যেটা দেখতে পাচ্ছো- হাতে পিস্তল, ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উপলক্ষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ম- আসলে ধর্মের নামে ধর্মান্ধতা। ধর্ম যেটা করতে বলে তার উল্টো। কোন শত্রুতা ছাড়াই মানুষ হত্যা করছে। জাফর ইকবালের উপর হামলা আমরা দেখেছি। আসলে তারা রেডিকালাইজড (মৌলবাদ) হয়ে গেছে। তরুণদের সামনে এইসব নানা গর্ত, নালা, ইট-পাথর পড়বে। এগুলো সম্পর্কে তোমরা সাবধান হও। মানুষের কাজের মধ্যে বৃত্তি-কুবৃত্তি উভয়ই থাকে। সেগুলো মধ্যে সুবৃত্তিগুলো জাগাতে হবে। তোমরা উৎকর্ষ সাধন করো মানবিক বৃত্তিগুলোর বিকাশ ঘটিয়ে। কুপ্রবৃত্তি, লোভ, হিংসা, দমন করবে। সেগুলোকে পায়ের নিচে রাখবে। কেননা মানুষের পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়। কথাটা পুরোনো হলেও এখনও নতুনের মতোই। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’

হাসান আজিজুল হক আরো বলেন, ‘আজ এখানে যাদের সমাবেশ তারা সবাই তরুণ। জীবনের কঠিন আঁচড় এখনো পড়েনি। কিন্তু পড়বে অবশ্যই। সারল্য, কর্মস্পৃহা পদে পদে বাধাগ্রস্ত হবে। কঠিন আঘাত সহ্য না করলে জীবনে কিছু করা যায় না। কচি গাছকে আঘাত করলে সহজেই ভেঙ্গে যায়। সেই গাছ মহিরুহে পরিণত হতে অনেক ঝড়-ঝাপড়া পাড়ি দিতে হয়। মহিরুহে পরিণত হলে তখন আর কোন আঘাতই আঘাত মনে হয় না।’

অনুষ্ঠানে এবছর বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া নাট্যব্যক্তিত্ব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মলয় ভৌমিক বলেন, ‘রাজশাহী দুষণমুক্ত শহর, কিন্তু আমরা কি বলতে পারি আমাদের মন দূষণমুক্ত? মনের দূষণ আজ সবজায়গায়। যার কারণেই আজকে সমাজে বৈষম্য। নারী-পুরুষের মধ্যকার এই বৈষম্য টিকিয়ে রাখতে কিছু উপাদান জিইয়ে রাখতে হয়- সন্ত্রাস, যুদ্ধ, ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা। এছাড়াও জিইয়ে রাখতে হয় যৌনতা বৈষম্য ও পৌরুষ। মাদকতা আর নিউ মিডিয়া। একটা শ্রেণী খুবই কৌশলে এগুলো টিকিয়ে রাখে। কারণ আমাদের তরুণ প্রজন্ম সমাজ থেকে, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন। সেজন্য নিউ মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে আমি বলি সামাজিক গোলযোগ মাধ্যম।’

মলয় ভৌমিক আরো বলেন, ‘১৯৫২, ১৯৭১ এদেশে সংঘঠিত হয়েছে তরুণরা অংশ নিয়েছিলো বলে। তখন তরুণরা দায়িত্ব নিতে জানতো। এখন যুদ্ধ লাগলে কতজন তরুণ আসবে? আসবে না। কারণ তাদের দমিয়ে রাখার সব ব্যবস্থা আমরা করে রেখেছি। আজকে তরুণদের বিপথে পরিচালিত করা হচ্ছে বলেই জাফর ইকবালের উপর এই তরুণরাই হামলা করছে। কারণ ওদের মাথায় বিজ্ঞান নেই। শুধু গোল্ডেন এ+ এর স্বপ্ন দেখিয়ে কোচিং বাণিজ্য, প্রাইভেট বাণিজ্য, গাইড বাণিজ্য ঠিক রাখছে এক শ্রেণীর লোক। যার কারণে তরুণরা ‘আমি’-কে ‘আমরা’-য় রুপান্তর করতে পারছে না। যে নিজের মর্যাদা নিয়ে সচেতন নয় সে নারীর মর্যাদা কিভাবে দেবে?’

রাজশাহী-৩ আসনের সাংসদ আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘সেই পুরোনো সময় থেকেই নারীরা লাঞ্ছিত হয়েছে। ঘরের চার দেয়ালের অভ্যন্তরে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ধর্মভীরু যারা তারা ধর্মের কথা বলে নারীদের আটকে রাখে। ৭১-এ অনেক নারী তাদের জীবন দিয়েছেন দেশের জন্য। অনেকে ধর্ষিত হয়েছেন। কিন্তু আমাদের সমাজ ধর্ষিতদের গ্রহণ করতে চায় না। দেশ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়ের সমান ভূমিকা রয়েছে। সবার উপরে মানুষ সত্য এটা আমাদের ভেতরে ধারণ করতে হবে।’

অনুষ্ঠানে রাজশাহী জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদের বলেন, ‘সমমর্যাদার সাথে নারীর জীবন পরিবর্তনের জন্য নারীকে নারী হিসেবে নয়, বরং মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। এর জন্য এখনই উপযুক্ত সময়। কেননা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নারীদের সমান মর্যাদা দিতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।’ এসময় তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত তরুণদের প্রতি আহবান জানান নারীদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে।


মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর সমন্বয়কারী শাহানা হুদা বলেন, ‘নারীদেরকে সমাজে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আমরা তরুণদের ঘিরে স্বপ্ন দেখি। আজকের তরুণরা আগামী দিনে সমমর্যাদার বাংলাদেশ গড়বে। বাড়িতে আমাদের মা-বোনরা যেসব কাজ করেন তাদের বেতন আমরা দিতে পারি না। কিন্তু অন্তর থেকে অন্তত তাদের কাজের স্বীকৃতি তো দিতে পারি।’

সমাজসেবী ও নারীনেত্রী শাহীন আক্তার রেণী বলেন, ‘ছেলে-মেয়ের সমান অধিকার আমরা কেন নিশ্চিত করতে পারছি না? তার কারণ আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। নারীকে পণ্য বা দাস মনে করা যাবে না। এতে বৈষম্য বাড়বেই। বরং পুরুষের পাশাপাশি নারীর শিক্ষাকেও সমগুরুত্ব দিতে হবে। কারণ নারীর জয় মানে সবার জয়।’

সম অধিকার নিশ্চিতের বিষয়ে সমকালের ফিচার সম্পাদক মাহবুব আজীজ বলেন, ‘সমকাল একটি পরিচ্ছন্ন, দায়িত্ববোধসম্পন্ন ও প্রগতিশীল পত্রিকা। যার সম্পাদকীয়তে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমাদের তরুণ প্রজন্মের মনুষ্যত্ব বিকাশ ও সম অধিকারের জন্য কাজে উদ্বুদ্ধ করতেই এমন উদ্যোগ। মনুষ্যত্বের অবমাননার জন্যই আজ বৈষম্য। নারী নয়, পুরুষ নয়, মানুষ হিসেবে নিজেকে চিন্তা করতে হবে। প্রত্যেকটি কাজের প্রতি, প্রত্যেকটি মানুষের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকতে হবে। আমরা কেউই চিরদিন থাকবো না, আর কিছু নিয়ে যাবো না। তাই আমি যখন চলে যাবো তখন যেন মনে হয় আমি কিছু ভালো কাজ করে গেছি।’

রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক হবিবুর রহমান বলেন, ‘আমার কিছু ছাত্র সেদিন আমাকে বলছে ৮ মার্চ বাংলাদেশে আর পালন যেন করতে না হয়। নারীর অধিকার নিয়ে আর গলা ফাটানো নয়, সম অধিকার নিশ্চিতে আমরা কাজ করবো। শিক্ষার্থীদের এই কথায় আমি খুবই আশান্বিত হয়েছি যে তারা নারীদের মানুষ হিসেবে চিন্তা করতে শিখছে। আমাদেরকে এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যেন রাত একটায় যে পথ দিয়ে একজন ছেলে নির্বিঘ্নে যেতে পারবে, সেই একই সময়ে একজন মেয়েও যেন নির্বিঘ্নে যেতে পারে।’

প্রবীণ সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান খান আলম বলেন, ‘আমি তরুণদের সাথে থাকতে ভালোবাসি। নিজেকে তরুণ ভাবতে ভালো লাগে। আরো ভালো লাগতো যদি আজকেই অনুষ্ঠানে নারীদের উপস্থিতি পুরুষের সমান হতো। কেননা অধিকার কেউ জন্মদিনের কেকের মতো মুখে তুলে দিবে না। অধিকার আদায় করে নিতে হবে।’

ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি ডা. এফএমএ জাহিদ বলেন, ‘তরুণরা দেশ গড়বে সমতার ভিত্তিতে। সেদিন আমার বাড়ির পাশে দেখলাম একটু রাতে একটা মেয়ে তার কয়েকজন ছেলে বন্ধুর সাথে গল্প করছে দেখে আশে পাশের মানুষ তাকিয়ে আছে যে, এত রাতে একটা মেয়ে কি করে। মেয়ে দেখলে আশ্চর্য নয়, বরং একসথে হাঁটার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।’

অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন একজন কৃষাণীও। পুরুষ ও নারীদের বেতন বৈষম্য নিয়ে আদিবাসী কৃষাণী ঝর্ণা লাকড়া বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষের সমান কাজ করেও বেতন কম পাই। পুরুষরা কাজ করে পাঁচশত টাকা পারিশ্রমিক পায় সেখানে একজন নারী পায় দুইশত পঞ্চাশ থেকে তিনশত টাকা। এর প্রধান কারণ নারীকে ছোট করে দেখার মনোভাব। এই অনুষ্ঠানে নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অধিকার আমাদেরকে আদায় করে নিতে হবে।’

বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে বিভিন্ন নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি ও নারী-পুরুষের কাজ নিয়ে সুহৃদদের মতামত। এসময় শুভ দাসগুপ্তের ‘আমি সেই মেয়ে’ কবিতা আবৃত্তি করেন সুহৃদ সোনিয়া তাসনিম, ফরহাদ মজহারের ‘কর্তৃত্ব গ্রহণ কর, নারী’ কবিতা আবৃত্তি করেন রাজশাহী আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি জয়দেব ভাদুড়ী, পুর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথপোকথন’ কবিতা আবৃত্তি করেন রাবি সুহৃদ মুস্তাফিজ ও সাব্বিকা জুই, রামেক সুহৃদ উন্মে সাবিহা আখতার তিথি আবৃত্তি করেন ‘সেই মেয়েটা’, নাচ পরিবেশন সুহৃদ অন্তরা, আশা, দোলা ও মোহনা, গান পরিবেশন করেন সুহৃদ স্বাধীন, রিফাত আরা, পার্থপ্রতীম। গম্ভীরা পরিবেশন করেন খোরশেদ আলম ও তার দল।


সুহৃদ সমাবেশের বিভাগীয় সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম আবেদ ও সমকালের রাজশাহী ব্যুরো প্রধান সৌরভ হাবিবের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ও নাট্যব্যক্তিত্ব আরিফ হায়দার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সুব্রত পাল, জেলা মহিলা পরিষদ সভাপতি কল্পনা রায়, রাজশাহী সুহৃদ সমাবেশের জেলা সভাপতি আহসান কবীর লিটন, সমকালের নাটোর জেলা প্রতিনিধি নবীউর রহমান পিপলু, নওগাঁ প্রতিনিধি এমআর ইসলাম রতন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সুহৃদ সমাবেশের সভাপতি মনু মোহন বাপ্পা, সাধারণ সম্পাদক জুয়েল মামুন, রামেক সুহৃদ সমাবেশের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) নাহিদ হাসান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাকিলা আকতার, জিনাত প্রমূখ।

দুপুরের খাবারের পর শুরু হয় রাজশাহীর তিনটি সুহৃদ সমাবেশের সাথে সাংগঠনিক আলোচনা। এতে উপস্থিত ছিলেন সমকালের সহকারী সম্পাদক ও সুহৃদ সমাবেশের বিভাগীয় সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম আবেদ, সমকাল রাজশাহী ব্যুরো প্রধান সৌরভ হাবিব, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও রাজশাহী কলেজ সুহৃদ সদস্যরা।
স/শ