রাজশাহীতে ওষুধ কারখানার কেমিক্যাল পানে যেভাবে মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়লেন তিন শ্রমিক

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহী নগরীর বিসিক শিল্প এলাকায় অবস্থিত একটি ওষুধ কম্পানীর কারখানায় রাখা কেমিক্যাল পান করে তিন  শ্রমিকের মৃত্যুর নিয়ে এখনো চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। বৃহস্পতিবার ওই তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এঁদেরে দুজনের মৃত্যু হয় হাসপাতালে আনার পথে এবং একজন মারা যান রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। এছাড়াও একই কমিক্যাল পান করে আরও সাত শ্রমিক রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

এর আগে গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে টিম ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড নামের ওই ওষুধ কম্পানীর কারখানা থেকে কেমিক্যাল নিয়ে তা একটি কম্পানীর তরল পানিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে পান করেন ১০ জন শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে তিনজন মারা যান গতকাল।

মৃত ওই তিন শ্রমিক হলেন, গোদাগাড়ী উপজেলার চৌব্বিশ নগর ডাইংপাড়া গ্রামের তফিজুলের ছেলে বকুল (৩৬) ও একই গ্রামের ইউসুফের ছেলে তৌহিদ (২৩) এবং দুলাল হোসেন (২৫)। তাঁরাসহ একই এলাকার অপর সাত নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে রাজশাহী নগরীর সপুরায় বিসিক শিল্প এলাকায় অবস্থিত টিম ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের গুদাম ঘর নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অপর সাত শ্রমিক হলেন, গোদাগাড়ী উপজেলার চৌব্বিশ নগর ডাইংপাড়া গ্রামের জামেদ আলী (৩০), পারভেজ হোসেন (২৫), মিনরারুল ইসলাম (২৮), মোশাররফ হোসেন (১৮) ওয়েন আলী (৩৮), টুলু (৪৫) এবং তাঁর ভাই খানজাহান (৪০)। তাঁদের মধ্যে টুলুর অবস্থা আশঙ্কাজনক। আর পারভেজ হলেন ভুটভুটি চালক। শ্রমিকদের প্রতিদিন তিনি তাঁর ভুটভুটিতে করে আনা-নেওয়া করতেন।

টিম ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ডাইরেক্টর (প্ল্যানিং) এমএ ওহাব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘ওই নির্মাণ শ্রমিকরা তাঁদের শ্রমিক নয়। তারা গুদাম ঘরটি যে ঠিকাদারকে নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই ঠিকাদার ওদের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। তবে টিম ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের স্টোরে এই ধরনের কিছু ‘র’ কেমিক্যাল ওষুধ তৈরীর জন্য রাখা হলেও সেটি শ্রমিকদের হাতে সহজে পৌঁছার কথা নয় বলেও দাবি করেন তিনি।

ওই কেমিক্যাল পানে অসুস্থত হওয়াদের মধ্যে ভুটভুটি চালক পারভেজ জানন, গত প্রায় ১৫ দিন ধরে রাজশাহী নগরীর সপুরায় বিসিক শিল্প এলাকার টিম ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ওই ওষুধ কম্পানী কারাখানার গুদাম ঘর নির্মাণে নির্মাণ শ্রমিক (রাজমিস্ত্রী) হিসেবে কাজ করছিলেন গোদাগাড়ী উপজেলার ্র্শিকুল ইউনিয়নের ডাইংপাড়া গ্রামের ১০-১২ জন শ্রমিক। এই শ্রমিকরা প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে পারভেজের ভুটভুটিতে করে রাজশাহী নগরীর ওই ওষুধ কারখানায় আসতেন নির্মাণের কাজ করতে।

গত মঙ্গলবার সকালেও একইভাবে ১১ জন শ্রমিক কাজে এসে যোগদান করেন। তবে কাজ শেষে রাত সাড়ে আটাটার দিকে বাড়িতে যাওয়ার সময় একটি বোতলে করে সেভেন আপের সঙ্গে কি যেন মিশিয়ে ওই শ্রমিকরা পান করছিলেন। তাদের মধ্যে দুজন অনেকটা বয়সে ছোট হওয়ায় ওই দুই কিশোরকে পান করতে দেওয়া হয়নি। একপর্যায়ে ভুটভুটি চালক পারভেজকেও সামান্য পান করতে দেওয়া হয়। ভুটভুৃটিতে ওঠার পরেও কয়েকবার তারা তরল পানিয় পান করেন। এরপর বাড়ির কাছাকাছি যেতেই অনেকেই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

ওই কেমিক্যাল পানকারী শ্রমিকদের মধ্যে জামেদ আলী পুলিশকে জানান, টিম কারখানার গুদাম ঘরে রাখা কিছু বোতলে এ্যালকোহল জাতীয় কেমিক্যাল ছিল। ওই কেমিক্যালের একটি বোতল মঙ্গলবার রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে নিয়ে নেন শ্রমিকরা। এরপর তার সঙ্গে সেভেন আপ মিশিয়ে পান করেন শ্রমিকরা। এভাবে কয়েকদফা তারা গাড়ীতে চড়ে বাড়িতে যাওয়ার সময়ও পান করেন। এরপর রাতে বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। পরের দিন বুধবারও দিনভর সেই কেমিক্যালের প্রতিক্রিয়ায় ঘুমাতে থাকেন জামেদ আলী। তাঁর মতো অন্যদেরও একই অবস্থা হয়। ফলে পরের দিন তাঁরা কেউ আর কাজে যেতে পারেননি।

এই অবস্থায় রাত পার হওয়ার পরে বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন কেমিক্যাল পানকারী কয়েকজন শ্রমিক। এঁদের মধ্যে তৌহিদ এবং বকুল ভোর ৫টার দিকে বাড়িতেই মারা যান। পরে একে একে অন্যরাও অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন। এর পর বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। পরে অসুস্থ আটজনকে উদ্ধার করে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এঁদের মধ্যে দুলাল হোসেন দুপুর দুইটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।

অসুস্থ জামেদ আলীর স্ত্রী শিখা বেগম বলছিলেন, মঙ্গলবার রাত প্রায় ১০ টার দিকে তাঁর স্বামী বাড়িতে পৌঁছেন। এরপর রাতে খাবারটুকু কোনো মতে খেয়েছেন তিনি। কিন্তু তার পরের দিনও প্রায় সারাদিন ঘুমিয়েছেন জামেদ আলী। তবে বৃহস্পতিবার দুই শ্রমিকের মৃত্যুর পরে জামেদ আলীও জানান, তিনিও সেই রাতে কেমিক্যাল পান করেছিলেন। পরবর্তিতে তিনিও অসুস্থতাবোধ করতে থাকেন। তবে কিভাবে তারা ওই কেমিক্যাল পেয়েছিলেন-তা কিছুই জানানি জামেদ আলী।

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল চারটার দিকে রামেক হাসপাতালের ১৬ এবং ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, কেমিক্যাল পানকারী ওই শ্রমিকদের মধ্যে একমাত্র ভুটভুটি চালক পারভেজের অবস্থায় অনেকটা ভালো। তিনি কথাও বলতে পারছেন। অন্যরা সবাই ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁদের মধ্যে টুলুর অবস্থা অনেকটায় আশঙ্কাজনক বলে জানান ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে দায়িত্বরত একজন ইন্টার্নি চিকিৎসক।

তিনি সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, একজন রোগী দুপুরে মারা গেছেন। এখনো ওই ওয়ার্ডে ভর্তি আছে আরো ৬ জন। তাদের মধ্যে টুলুর অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ।

টুলুর পাশেই বসেছিলেন তার স্ত্রী শাকিমা বেগম এবং ছেলে শরিফুল ইসলামসহ পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্য। তাঁরা সবাই দাবি করেন, টুলু কখনো সিগারেটও পান করেন না। কিন্তু তিনিই কেনই বা সেই কেমিক্যাল পান করলেন-সেটা কেউই ভেবে পাচ্ছেন না।’

একই দাবি করেন যুবক মোশাররফের (দুলাভাই আকবর আলী। তিনি সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ‘আমার শ্যালককে কখনো সিগারেট বা অন্যকিছু পান করতে দেখিনি। সেই ছেলে কাজে গিয়ে কেন কেমিক্যাল পান করলো-তা বুঝতে পারছি না।’

তবে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, কয়েকজন শ্রমিক এর আগেও ওই কারখানাটিতে কাজ করেছে। তারাই জানত কারখানার কোথায় কি আছে। তাদেরই দুই-একজন কারখানার গুদাম থেকে ওই কেমিক্যাল সংগ্রহ করে এনে অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে মিলে তরল পানিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে পান করে বলেও দাবি করে সূত্রটি।

জানতে চাইলে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জামিলুর রহমান সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ‘কয়েকজন শ্রমিক হাসপাতালে ভর্তি আছে। তাদের মধ্যে একজন মারা গেছে। কিন্তু তারা কি পান করে অসুস্থ হয়েছে বা একজনের মৃত্যু হয়েছে চিকিৎসাধীন অবস্থায়-তা এখনো পরিস্কার নয়। লাশের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আসার পরেই আমরা এ নিয়ে বলতে পারবো।’

গোদাগাড়ী থানার ওসি হিফজুর আলম মুন্সি সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, কেমক্যাল পান করেই তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। আরও সাতজন শ্রমিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এদিকে একই গ্রামের তিন শ্রমিকের মৃত্যুতে পুরো গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। গতকাল সকাল থেকেই ওই গ্রামের বাতাস ভারি হতে থাকে। খবর পেয়ে আশে-পাশের  গ্রামের লোকজনও ছুটে যেতে থাকেন চৌব্বিশ নগর ডাইংপাড়া গ্রামে।

জানতে চাইলে স্থানীয় ঋশিকুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম টুলু সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, ‘এটি একটি মর্মান্তিক ঘটনা। একই গ্রামের তিন শ্রমিকের একসঙ্গে মত্যুর বিষয়টি সত্যিই হৃদয়বিদারক। তারা হয়তো জানতোই না, ওই কেমিক্যাল আসলে কি? কেউ হয়তো শ্রমিকদের সেটি পান করার জন্য প্রলুব্ধ করেছে। আর তা পান করেই একে মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়েছে তারা। অন্যরাও জীন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে।

স/আর