রাজশাহীতে ইঁদুর বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে সফল মামুন

শাহিনুল আশিক:


শখের বসে ইঁদুর লালন-পালনের শুরু। এখন তা ব্যবসায় পরিণত করেছেন সালাউদ্দিন মামুন। তিনি বাণিজ্যিকভাবে ইঁদুর উৎপাদন করছেন। ইঁদুর উৎপাদনে সাফল্যও পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ল্যাব সহকারী সালাউদ্দিন মামুন। নিজ বাড়িতে মাত্র চারটি ইঁদুরের বাচ্চা নিয়ে যাত্রা শুরু রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালীর সমসাদিপুর এলাকায়।

ঘটনা বিস্মিত হওয়ার মতই যখন কিনা বছরে শত শত কোটে টাকার দানা-ফসল ইঁদুরে খায় কিংবা নষ্ট করে। সরকারের কর্মসূচিও আছে অধিক ইঁদুর নিধনকারীকে পুরষ্কৃত করার। এই পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিকভাবে ইঁদুর চাষ- বিস্মিত হওয়ার মতই ঘটনা বটে কিন্তু এটাই সত্য। তবে ল্যাব সহকারী মামুন দেশি ইঁদুরের উৎপাদন করছেন না। গবেষণার কাজে উপযোগী অ্যালবিনো প্রজাতির ইঁদুরের অ্যালবিনো প্রজাতির সাদা ইঁদুরের খামার করেছেন তিনি।



জানা গেছে, প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা থেকে ইঁদুর লালন পালন শুরু। উদ্দেশ্য ছিলো বাচ্চাগুলো বড় হলে ছেড়ে দেবেন। কিন্তু পরে জানতে পারেন ইঁদুর খামারের মাধ্যমেও উৎপাদন করাও সম্ভব। দুই মাসের মাথায় অপ্রত্যাশিতভাবে লাভের মুখ দেখেন তিনি। গবেষণায় এই সাদা ইঁদুরের বেশ চাহিদা থাকায় দামও ভালো পাচ্ছেন তিনি। স্বপ্ন দেখছেন দেশব্যাপী বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ইঁদুর সরবরাহ করার।

সালাউদ্দিন মামুন জানান, ২০১৭ সালের শেষের দিকে তিনি সহকর্মী মাসুদের সাথে ল্যাবের সামনে বসেছিলেন। এসময় উদ্ভিদ বিজ্ঞানের এক পিএইডি গবেষক মাসুদকে ইঁদুরের চারটি বাচ্চা দিয়ে সেগুলোকে ছেড়ে দিতে বলেন। ছোট বাচ্চাগুলো দেখে মায়া হয় মামুনের। কিছুদিন রেখে বড় হলে ছেড়ে দিবেন এ ভাবনা থেকে বাচ্চাগুলো বাড়িতে নিয়ে আসেন তিনি।



সালাউদ্দীন মামুন আরও জানান, বাড়িতে এনে ইঁদুরগুলোকে তিনি জুতা রাখার বাক্সে কাপড় দিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। খাবার হিসেবে কিছু চাল, গম দিতেন। এরই মধ্যে বিড়াল একটি ইঁদুরের বাচ্চা খেয়ে ফেলে। তিনি বাকি তিনটাকে বিড়ালের হাত থেকে রক্ষা করতে ব্যবস্থা নেন এবং নিয়মিত খাবারও দিতে থাকেন। মাস খানেক পর একটি ইঁদুর ১০টা বাচ্চা জন্ম দেয়। তার সপ্তাহখানেক পরে আরও একটি ইঁদুর ১০টা বাচ্চা দেয়।

শখ থেকে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার ব্যাপারে মামুন বলেন, ‘ইঁদুরের বাচ্চা দেয়ার বিষয়টি আমি বিভাগে গল্প করি। এসময় জামার্নির এক গবেষক প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মিউজিয়ামে ট্যাক্সিডার্মি নিয়ে কাজ করছিলেন। তার গবেষণার জন্য আমার কাছে ইঁদুরগুলো চাইলেন। তখন আমি তাকে ২০টি ইঁদুর দিলাম। তিনি আমাকে ১ হাজার টাকা দিলেন। টাকা পেয়ে আমি কিছুটা অবাকই হলাম। এরপরই মূলত ইঁদুর পালনে আগ্রহী হয়ে উঠলাম এবং কিছুটা পড়াশোনাও শুরু করলাম।’

সালাউদ্দিন মামুন এখন তার নিজ বাড়ির একটি ঘরে ইঁদুর পালন করছেন। সাপ, বিড়ালসহ অন্যান্য প্রাণীদের থেকে রক্ষা করতে কক্ষের চারদিকে নেট লাগানো হয়েছে। ইঁদুরগুলোকেও নিয়মিত চাল, গম, ভূট্টা, ডাল জাতীয় খাবার খাওয়ানো হয়।

বিভিন্ন জায়গায় বিক্রির পরে বর্তমানে তার খামারে ৫০টি স্ত্রী ও ৩০টি পুরুষ ইঁদুর রয়েছে। এছাড়া বাচ্চা মিলে ৮০টি হবে। প্রত্যেকটি স্ত্রী ইঁদুর এক থেকে দেড় মাস পরপর ৮-১০টি বাচ্চা দেয়। শুরুর দিকে কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণার জন্য তার কাছ থেকে ইঁদুর কিনতেন। তবে বর্তমানে রাবি ছাড়াও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার একাধিক ফার্মাসিউটিক্যাল ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান তার খামার থেকে ইঁদুর নিয়ে যাচ্ছেন।



ব্যতিক্রমী এই খামারি বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর ভ্যাক্সিন তৈরির চেষ্টা করছেন এমন একটি নামকরা দেশীয় প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি আমার কাছ থেকে ৫০টি ইঁদুর নিয়েছেন। অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ইঁদুর নিচ্ছে। প্রথম দিকে একেকটি ইঁদুর ৪০ টাকা করে বিক্রি করতাম। বর্তমানে একটি ইঁদুর ৭০ টাকা দরে বিক্রি করছি। চাহিদা প্রচুর। সেই অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারি না।’

সালাউদ্দীন মামুনের খামার থেকে ইঁদুর নিয়ে গত দুই বছর যাবত গবেষণা করছেন রাজশাহী জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আবু রেজা। তিনি বলেন, ‘ইঁদুরে জিনের সাথে মানুষের জিনের বেশ মিল থাকায় গবেষণার প্রাথমিক ধাপে অ্যালবিনো প্রজাতির ইঁদুরের বেশ চাহিদা রয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে ইঁদুর পালনে আগ্রহীদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে তা বাংলাদেশের গবেষণাখাতকে আরও সমৃদ্ধ করবে।’

ইঁদুরের বংশ বিস্তার নিয়ে কাজ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সাউদ। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তি উদ্যোগে ইঁদুর পালন এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সালাউদ্দিন মামুন যেহেতু বাণিজ্যিকভাবে পালন করার চিন্তাভাবনা করছেন সেক্ষেত্রে বাসস্থান, খাবার ও তাপমাত্রা এসব বিষয়গুলো আরও বৈজ্ঞানিকভাবে করা উচিত। সেক্ষেত্রে তার কোনো ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে আমি তা দিতে প্রস্তত।’

স/আ