পড়া-শোনার খরচ জোগাতে হয়েছিলেন পালকপূত্র

রাজশাহীতে আবাসন ব্যবসার নামে প্রতারণা করে কোটিপতি মোস্তাফিজ


নিজস্ব প্রতিবেদক:

মোস্তাফিজুর রহমান। বয়স প্রায় ৪০ বছর। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে। বাবার নাম আব্দুর রাকিব। দরিদ্র পরিবারের সন্তান মোস্তাফিজ পড়া-শোনার সুবাদে একসময় পাড়ি জমান রাজশাহীতে। এর পর আর্থিক কষ্টের মুখে রাজশাহী নগরীর রাজার হাতা এলাকার প্রয়াত ব্যাংক কর্মকর্তা মাইনুল হাসানের দত্তক ছেলে হিসেবে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেন। নি:সন্তান মাইনুলের মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রী নাসরিন সুলতানাকে ফুসলিয়ে আবাসন ব্যবসার নাম করে পালিত বাবার জমানো টাকাগুলো নিয়ে নেন। এর পর বছর চারেক আগে ‘গ্রীণ প্লাজা রিয়েল অ্যাস্টেট’ নাম দিয়ে মোস্তাফিজ রাজশাহী নগরীতে ডেভলপারের ব্যবসা শুরু করেন।

রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানা মোড়ের কাছে একটি জায়গা ডেভেলপার হিসেবে নেন মোস্তাফিজ। সেখানে সাত তলা ভবনের কাজ শুরুর পর থেকেই মোস্তাফিজের প্রতারণা শুরু হয়। একই ফ্লাট দুই-তিন জায়গায় বিক্রি করতে শুরু করেন মোস্তাফিজ।

এসব নিয়ে রাজশাহী সিটি মেয়র ও চেম্বার অব কমার্সের পরিচালকের জমা পড়ে ৭-৮টি অভিযোগ। মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের হস্তক্ষেপে কয়েকজন ভূক্তভোগী ফ্লাটও বুঝে পেয়েছেন। কিন্তু এখনো ফ্লাটের নিবন্ধন পাননি তাঁরা। আবার যারা ফ্লাট পাননি তাঁরা এখনো ঘুরছেন টাকার জন্য।

মোস্তাফিজের প্রতারণা এখানেই শেষ হয়নি। এর পর আরও ৫টি জায়গা নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে দুটি জায়গায় ফ্লাটের কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু একেকটি ফ্লাট বিক্রি করেছেন একাধিক ব্যক্তির কাছে। আর বাকিগুলোতে কাজ শুরু করতে না পারলেও সেখানেও ফ্লাট বিক্রি করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিতে শুরু করেন। জমির মালিকদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি কাউকেই ঠিকমতো দেননি। আবার কাউকে কাউকে একেবারেই দেননি। এ নিয়েও ভূক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। আবার কারও বিরুদ্ধে উল্টো মামলা করে জেলও খাটিয়েছেন মোস্তাফিজ।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও চিকিৎসক মহিবুল হাসান অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার একটি জমিতে ভবন নির্মাণ করার জন্য মোস্তাফিজকে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে কোনো শর্তই মানেনি। এর পর আমি চুক্তি বাতিল করেছি। কিন্তু প্রতারক মোস্তাফিজকে ১০ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি। সে একজন প্রতারক। প্রতারণাই তার মূল কাজ।’

রাজশাহী নগরীর দরিখরবোনা এলাকার বাসিন্দা আবু হানিফের একটি জমি বছর খানেক আগে ভবন নির্মাণের জন্য ডেভেলপার হিসেবে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পের মাধ্যমে নেন মোস্তাফিজ। কিন্তু বাড়ির কাজ শুরু করতে পারেননি। এমনকি আবু হানিফকে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার কথা থাকলেও মোস্তাফিজ দিতে পারেননি। বাধ্য হয়ে আবু হানিফ তার জমিটি অপর একটি ডেলরপারকে রেজিস্ট্রি করে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মোস্তাফিজ আবু হানিফের নামে উল্টো মামলা করে তাঁকে আড়াই মাস জেলও খাটান। পরে জামিনে মুক্তি পান তিনি।

আবু হানিফ বলেন, ‘আমার পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে মোস্তাফিজ। আমি এর বিচার চাই। আমি জমি মালিক হয়ে আমাকেই জেল খাটতে হলো।’

রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার নিকট থেকে একটি ফ্লাট বিক্রির কথা বলে ২৫ লাখ টাকা নিয়েছিল মোস্তাফিজ। কিন্তু পরে জানতে পারি ওই ফ্লাটটি আরেকজনের নিকট বিক্রি করেছেন। শেষে আমি মেয়র সাহেব ও নগর পুলিশের কাছে অভিযোগ করে কয়েক মাস ঘুরে আরেকটি ফ্লাট দিতে চেয়েছে। কিন্তু রেজিস্ট্রি দেয়নি এখনো।’

রাজশাহী গোদাগাড়ীর বাসিন্দা এজাজুল হকের নিকট থেকে ফ্লাট বিক্রি মোস্তাফিজ ১২ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ফ্লাটটিও অপরজনের নিকট বিক্রি করেন মোস্তাফিজ। শেষে এজাজুল হক টাকা ফেরত চাইতে বাধ্য হোন। এর পর টাকা ফেরতের কথা বলে এজাজকে রাজশাহীতে ডেকে নেন মোস্তাফিজ। কিন্তু টাকা ফেরত না দিয়ে তাঁর সাঙ্গ-পাঙ্গ দিয়ে জোর করে এজাজের সঙ্গে করা ফ্লাট বিক্রির চুক্তিপত্রের মূল কাগজগুলো কেড়ে নেওয়া হয়। তার পর ভয়ভীতি দেখিয়ে এজাজকে বাড়িতে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

এজাজ কালের বলেন, ‘আমার সঙ্গে যে প্রতারণা করেছে মোস্তাফিজ, এমন প্রতারণা যেন আর কারও সঙ্গে করতে পারতে না পারে। আমি ওর বিচার চাই। সে একজন প্রতারক। আমার মতো অনেক মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে মোস্তাফিজ। সে প্রতারণা করেই কোটিপতি হয়েছে। হ্যারিয়ার গাড়ি কিনেছি। অথচ তাঁর বাপ দিনমজুর। যার কাছে সে দত্তক ছিল, তাদের টাকাও মেরে দিয়েছে। এভাবে সে কোটিপতি হয়েছে।’

রাজশাহী নগরীর বালিয়া পুকুর এলাকার ওমর ফারুক অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাকেও ফ্লাট দিব বলে ৩৫ লাখ টাকা নিয়েছিল। শেষে একাধিকবার শালিস করে কয়েক দফায় সেই টাকা আমি নিয়েছি। এখনো লাখ তিনেক টাকা পাই। মোস্তাফিজের কাজই হলো মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা।’

সাদিকা খাতুন নামের আরেক নারী বলেন, ‘আমার নিকট থেকে ৪০ লাখ টাকা নিয়েছে মোস্তাফিজ। কিন্তু ফ্লাট দিতে পারেনি। আমি টাকার জন্য এখন ঘুরতেছি। এ নিয়ে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সে অভিযোগ করেছি। তাতেও লাভ হয়নি।’

ফৌজিয়া নামের আরেক নারীও রাজশাহী সিটি মেয়রের কাছে অভিযোগ করেছিলেন মোস্তাফিজের প্রতারণার শিকার হয়ে। পরে মেয়রের চাপে ফৌজিয়াকে ফ্লাট দেয়া হয়েছে। কিন্তু রেজিস্ট্রি করে দিচ্ছেন না মোস্তাফিজ। এ নিয়ে আতঙ্কে আছেন স্কুলশিক্ষক ফৌজিয়া। তিনি দিয়েছেন ৬৪ লাখ টাকা। তবে ফ্লাটে উঠতে পারেননি এখনো কাজ শেষ না হওযায়। ফৌজিয়া বাধ্য হয়ে নিজেই বাকি কাজ করাচ্ছেন তার টাকায়।

‘গ্রীণ প্লাজা রিয়েল অ্যাস্টেট’র চেয়ারম্যান হিসেবে কাগজে-কলমে রাখা হয়েছে প্রয়াত ব্যাংক কর্মকর্তা মাইনুল হাসানের স্ত্রী নাসরিন সুলতানার (মোস্তাফিজের দত্তক বাবা-মা) আপন ভাই ওয়ালিউর রহমান বাবুকে।

বাবু অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার বোনের নিকট থেকে অনেক টাকা নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেছিল মোস্তাফিজ। সেই টাকার কোনো হিসেব নাই। আমাদের একটা জমিও ডেভলপার হিসেবে নিয়েছে তিন বছর আগে। ওই জমিতে থাকা বাড়িটি ভেঙে ফেললেও এখনো কাজ শুরু করতে পারেনি। আমরা এখন ভাড়া বাড়িতে থাকি।’

বাবু বলেন, ‘আমাকে চেয়ারম্যান করে রাখা হলেও আমি ওর কোনো কাজের বিষয়ে খোঁজ রাখি না। তবে তার কাছে অনেক মানুষ আসে টাকার জন্য। ওর কারণে আমার বোনটি এখন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝেই শুধু কান্না-কাটি করে। ঠিকমতো কথাও বলতে পারে না। আমরা এখন কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোস্তাফিজ এভাবে রাজশাহী নগরী ও আশে-পাশের জেলার অন্তত অর্ধশত মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। টাকা ফেরত দেওয়ার ভয়ে তিনি অনেকটা সময় পলাতক থাকছেন। ঠিকমতো অফিসেও বসছেন না।’

জানতে চাইলে মোস্তাফিজ বলেন, ‘কয়েকটি ফ্লাট নিয়ে সমস্যা ছিল। সেগুলোর অনেকটায় সমাধান করেছি। কিছু ঝামেলা আছে, সেগুলোও সমাধান করা হবে। তবে আমি কারও সঙ্গে প্রতারণা করিনি। আবু হানিফ নিজেই আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।

রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, ‘সে একসময় চেম্বারের পরিচালক পদও বাগিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তার নানা কাণ্ডে তাঁর সদস্য পদ নাই। আমাদের কাছে তিনটা অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে টাকা প্রতারণার। এর মধ্যে একটার মীমাংসা করে দিয়েছি। আর দুটির হয়নি। কারণ সে এখন আর চেম্বারের কেউ না। তাঁর অফিস চেম্বার ভবনেই। সে ভাড়া নিয়েছে। গত ১৮ মার্চ ওই অফিস ছেড়ে দেওয়ার নোটিশও দেওয়া হয়েছে তাকেঁ।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হেমায়তুল ইসলাম বলেন, ‘মোস্তাফিজের নামে অনেক অভিযোগ। আমরা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি। পুলিশ এসব নিয়ে কাজ করছে।’