রাজশাহীতে অর্ধশতাধিক চিকিৎসক নার্স করোনায় আক্রান্ত, ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা

নিজস্ব প্রতিবেদক :

রাজশাহীতে একের পর এক করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। পাশাপাশি ক্রমেই নগরীর করোনা পরিস্থিতি যেমন ভয়াবহ হয়ে উঠছে, তেমনি চিকিৎসা নিয়েও ভোগান্তি বাড়ছে সাধারণ মানুষের মাঝে। করোনার আইসোলেশন ইউনিট হিসেবে মিশন হাসপাতালকে বেছে নেওয়া হলেও সেখানে তেমন কোনো চিকিৎসায় হচ্ছে না বলেও অভিযোগ ওঠেছে। এমনকি রোগীদের দেখ-ভালের তেমন কোনো ব্যবস্থা নাই। ফলে রোগীদের অক্সিজেন দেওয়ার মতোও জনবল পাচ্ছে না মিশন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে করে রোগীরা নিজেদের প্রয়োজনে কখনো কখনো নিজেরাই অক্সিজেন নিতে বাধ্য হচ্ছেন।


আবার রোগীর সঙ্গে সেবা-যত্ন করতে রাখা হচ্ছে স্বজনদের। সেসব স্বজনরাই রোগীর ওষুধ এবং খাবারসহ নানা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বাইরে বের হচ্ছেন। এতে করে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে বলে ই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে হঠাৎ করে রামেক হাসপাতালের চিকিৎসক নার্সরাও ব্যাপক হারে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। রাফা নামের এক চিকিৎসকসহ তাঁর পরিবারের চার সদস্যসহ করোনায় আক্রান্তও হয়েছেন এরই মধ্যে। এমনকি হাসপাতালের কম্পিউটার অপারেটর পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। সর্বশেষ গত ৩০ জুন রামেক হাসপাতালের ৭ চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এ নিয়ে গত ১৫ দিনে রামেক হাসপাতালের অন্তত অর্ধশতাধিক চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। একের পর এক করোনা আক্রান্ত নিয়ে চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যেও চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

রামেক হাসপাতাল সূত্র মতে, গত ৩০ জুন পর্যন্ত রাজশাহীর ২৪ জন চিকিৎসক, ২৫ জন নার্স, এবং ১৬ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক করেনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর বাইরে হাসপাতালের অন্যানা কর্মচারী রয়েছেন আরও অন্তত ২০ জন।

অন্যদিকে গতকাল বুধবার সকালে পর্যন্ত রাজশাহীতে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৬৭৯ জন। এর মধ্যে রাজশাহী নগরীতেই করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৪৫৫ জন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে নমুনা পরীক্ষা শেষে নগরীর ৬০ জনের করোনা শনাক্ত হয়। গত কয়েকদিন ধরে গড়ে অন্তত ৫০ জন করে প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন নগরীতে।

এদিকে রাজশাহীতে গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ জনে। এর মধ্যে নগরীতেই ৫ জন। এর বাইরে করোনা উপসর্গ নিয়ে প্রতিদিন অন্তত দুইজনের মৃত্যু হচ্ছে। সর্বশেষ গতকাল বুধবার সকালে মারা গেছেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ল্যাব সহকারী মাসুদ রানা (৪৫)।

মাসুদ রানার ভাতিজা সুমন হোসেন অভিযোগ করে জানান, গত মঙ্গলবার মাসুদ রানাকে জ¦র-সর্দি ও শ^াসকষ্ট নিয়ে রামেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় হাসপাতালের করোনা আইসোশলেশর খ্রিষ্টান মিশন হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে দিনভর অক্সিজেনও ছিল না। শেষে মাসুদ রানার পরিচিত একজনকে মাধ্যমে বাইরের থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে এনে ক্লিনিক থেকে লোক ডেকে নিয়ে এসে অক্সিজেন মাস্ক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তার পরেও মাসুদ রানার অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকলে তাঁকে রামেক হাসপাতালে নেওয়ার জন্য বলা হয় খ্রিষ্টান মিশন হাসপাতাল থেকে। কিন্তু হাসপাতালের জরুরী বিভাগ থেকে তাঁকে ভর্তি করাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। শেষে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে মাসুদ রানাকে হাসপাতালের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কোরোনা ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তবে সেখানেও তেমন কোনো চিকিৎসা পাননি মাসুদ রানা। এমনকি ওই ওয়ার্ডের নোংরা শয্যাগুলোও পরিস্কার করে নিতে রোগীর সজনদের। শেষে গতকাল ভোর ৫টার দিকে মাসুদ রানা মারা যান।

এর আগেও এই হাসপাতালে গত কয়েকদিন আগে একজন রোগী নিজেই অক্সিজেন সিলিন্ডার টেনে এনে তাঁর নাকে নিতে দেওয়ার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এর বাইরে করোনা আক্রান্ত রোগীর স্বজনরাও বাধ্য হয়ে থাকছেন রোগীর সঙ্গে। ফলে তারা বিভিন্ন সময়ে রোগীর ওষুধ কেনা থেকে শুরু করে খাবার কিনতেও বাইরে আসছেন। আবার তারা হাসপাতালে প্রবেশ করছেন। এতে করেও করোনা ছড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

অন্যদিকে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ডা. মাহাবুবুর রহমান খান জানান, দেশের বাজারে অল্পদামে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী আসছে। এগুলোর মাণ নিয়ে সংশয় রয়েছে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান করেছেন। এগুলোর মান নিয়েও সংশয় রয়েছে।

দেশের বাজারে যেসব মাস্ক, গ্লাবস, পিপিই হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি করা হচ্ছে তার অধিকাংশই মানহীন ও নকল। যা ব্যবহার করে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন ব্যাপক হারে সংক্রমিত হচ্ছেন।

আবার হাসপাতালে সকল রোগীকে একত্রিত করার ফলেও চিকিৎসকসহ স্থাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাসপাতালে রেড, গ্রীন ও ইওলো জোন সিস্টেম নেই। এটা করা উচিত।

রামেক হাসপাতালের উপপরিচালক সাইফুল ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি। কিন্তু একের পর এক চিকিৎসক নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী এমনকি হাসপাতালের সাধারণ কর্মীরাও করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন। এতে করে তাঁদের মাঝেও বিরাজ করছে আতঙ্ক। এই অবস্থায় চিকিৎসাসেবা কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই।’