রাকসু নির্বাচনের দাবি শিক্ষার্থীদের, প্রশাসন বলছে পরিবেশ তৈরী হচ্ছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) নির্বাচন ঝুলে আছে দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে আগামী ছয় মাসের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচনের সময় বেধে দেওয়া হলেও রাকসু নির্বাচন নিয়ে এখনো কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে আদৌ কবে নাগাদ রাকসু নির্বাচন দিবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা দিবে কিনা সেটি নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।

অথচ দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন না থাকায় মূলত রাকসুর সব কার্যক্রম এখন স্থগিত। তবে বছর বছর শিক্ষার্থী ভর্তির সময় ঠিকই ১৫ টাকা করে চাঁদা তুলে পকেট কাটা হয় শিক্ষার্থীদের; কিন্তু বছরের পর বছর কেটে গেলেও ছাত্র আন্দোলনের সুতিগার হিসেবে পরিচিত রাকসু সংগঠনটি চালু করার কোনো উদ্যোগ এখনো লক্ষ্য করা যায়নি। এ নিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের মধ্যে রয়েছে দিধা-বিভক্তি। তবে অধিকাংশই চান এ নির্বাচন হোক। আর নির্বাচনের মাধ্যমেই ফিরে আসুক শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের বা শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সংগঠন রাকসু।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, নির্বাচনের পরিবেশ তৈরী হলেই প্রশাসন নির্বাচন দিবে; কিন্তু সেই পরিবেশ ছাত্রসংগঠনগুলো তৈরী করতে পারছে না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র মতে, ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর প্রথম রাকসু নির্বাচন হয় ১৯৫৬-৫৭ মেয়াদে। ওই সময় এর নাম ছিল রাজশাহী ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (রাসু)। আইয়ুব খানের শাসনামলে এর কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর ১৯৬২ সালে এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (রাকসু) নামে যাত্রা শুরু করে। এখন পর্যন্ত ১৪ বার রাকসু নির্বাচন হয়েছে। সবশেষ ১৯৮৯-৯০ মেয়াদের জন্য নির্বাচন হয়। ১৯৭০ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সামরিক শাসনামলে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল ছাত্র সংসদের কার্যক্রম।

সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৯-৯০ মেয়াদে। ১৯৯৩ সালে তৎকালীন উপাচার্য আনিসুর রহমান এক আদেশ বলে রাকসুর কার্যকরী সংসদ বাতিল ঘোষণা করেন। কিন্তু প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর আন্দোলনের মুখে কর্তৃপক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা নিলেও ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তা আর অনুষ্ঠিত হয়নি। সেই হিসেবে গত ২৭ বছর ধরে রাকসু নির্বাচনের মুখ দেখেনি। ফলে স্থবির হয়ে আছে রাকসুর কার্যক্রম। তবে সংগঠন না থাকলেও এখনো প্রতি বছর শিক্ষার্থী ভর্তির সময় আদায় করা হয় ১৫ টাকা করে চাঁদা।


বিস্ববিদ্যালয় সূত্র মতে, সর্বশেষ নিবাচনে রাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমান বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক রেজভী আহমেদ এবং জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমানে উচ্চ আদালতের বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস বাবু। এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব এসেছে দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো থেকে। রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় রাবিতে কখনো ছাত্রদল, কখনো ছাত্রশিবির আবার কখনো ছাত্রলীগের দাপট চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। এতে করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা হারিয়েছেন তাদের নেতৃত্ব এবং অধিকার আন্দোলনের পথ।

রাকসুর গঠনতন্ত্রে যা আছে:
১৯৬২ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের গঠনতন্ত্র অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আগে এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (রাসু) হিসেবে পরিচিতি ছিল। গঠনতন্ত্রে সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বলা হয়, সত্যিকার নাগরিক এবং নেতৃত্ব তৈরি করা, দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও অনুমোদিত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরি, বক্তৃতা, লিখন, বিতর্ক ইত্যাদিতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করার জন্য শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করতে কাজ করবে রাকসু। এছাড়া মানবিক-সামাজিক বিভিন্ন কর্মকা- আয়োজনও ছিল রাকসুর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে। তবে রাকসু নির্বাচন দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত থাকায় সংগঠনের এসব কার্যক্রম আর লক্ষ্য করা যায় না। এর ফলে ক্যাম্পাসে গড়ে উঠছে অসুস্থ ছাত্র রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা-এমনটিই মনে করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে মাঝে-মাঝেই দেখা দেয় হানাহানি-খুনোখুনি।

গঠনতন্ত্রে কোষাধ্যক্ষের পদের বিষয়ে বলা আছে, অন্যান্য পদে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে থেকে একজনকে কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ করবেন সভাপতি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এখানে নির্বাচন না হলেও প্রতি বছর শিক্ষার্থী ভর্তির সময় ১৫ টাকা করে চাঁদা উত্তোলন করা হয়। এই টাকা কোন কাজে ব্যয় হয়-তারও কোনো হিসেব জানেন শিক্ষার্থীরা; কিন্তু বছরের পর বছর তাঁরা প্রশাসনের ধার্যকৃত চাঁদা দিয়েই আসছেন।

সংগঠন স্থবির তবু ওঠে চাঁদা:
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি নিয়মিত ছাত্র সংসদের সদস্য হতে পারবে। তারা রাকসুর সব সুযোগ-সুবিধা ও কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে। সংসদ পরিচালনার জন্য ২০ সদস্যের নির্বাহী কমিটি থাকবে। যেখানে উপাচার্য হবেন সভাপতি। সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বাকি পদগুলোতে সদস্যরা ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন।

নির্বাচন নিয়ে ছাত্র নেতারা যা বলছেন:
রাকসু নির্বাচন সম্পর্কে রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘আমরা চাই রাকসু নির্বাচন হোক। ছাত্রদের প্রকৃত আন্দোলনের সুতিকাগার হিসেবে থাকুক রাকসু। শিক্ষার্থীরাও এই সংগঠনটির ব্যানারেই এক কাতারে থাকুক। কিন্তু এ নির্বাচন দীঘদিন ধরে ঝুলে রাখা হয়েছে। আমরা রাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে নতুন উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিয়েছি। তিনি আমাদের দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ছাড়া অন্য সব বৈধ ছাত্র সংগঠনগুলো নিয়ে রাকসু নির্বাচন হোক সেটি আমাদের প্রাণের দাবি।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাকসু নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়সারাগোছের কথা বলছে। শায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করলে ছাত্রসংগঠনগুলো এমনিতেই সে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য হবে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো পরিবেশও আছে, যা নির্বাচনের উপযুক্ত সময়। কিন্তু তারা নির্বাচন না দিয়ে সময়ক্ষেপন করছে।’

রাবি ছাত্রদলের সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন ও দাবির বিষয়ে কথা বলার কোনো জায়গা নেই। রাকসু নির্বাচন নেই বলে মেধাবী নেতৃত্বও উঠে আসছে না।’ বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর রাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক দিলীপ রায় বলেন, ‘নব্বইয়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দেয়া হয়। এর কারণ ছিল নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোকে অধিকতর সুবিধা করে দেয়া। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব সংস্কৃতিতে সুনাগরিক ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রক্রিয়া থমকে গেছে।’

রাবি ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি তাসবির উল ইসলাম কিঞ্জল বলেন, ‘ছাত্র সংসদ না থাকায় বিগত দুটি সিনেট অধিবেশনে ছাত্র প্রতিনিধিরা অংশ নিতে পারেনি। সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধির অভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনায় মতামত দেয়া থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। যা বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান।’

নির্বাচনের দাবিতে ভিসিকে স্মারকলিপি:
গত ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনের দাবিতে ভিসিকে স্মারকলিপি দিয়েছেন ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মঞ্চ’। টানা ৫ দিন গণস্বাক্ষর কর্মসূচি শেষে গত ১৯ ডিসেম্বর স্মারকলিপি দেন শিক্ষার্থীরা। ওই সময় রাবি ভিসি কার্যালয়ে না থাকায় তার পক্ষে স্মারকলিপি গ্রহণ করেন প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার সাহা।

স্মারকলিপি গ্রহণকালে প্রো-ভিসি শিক্ষার্থীদের ওই সময় বলেন, ‘বিষয়টি সহজ প্রক্রিয়া নয়। রাকসু নির্বাচন শুধু আমরা চাইলেই হবে না, সরকারের হস্তক্ষেপ লাগবে। আমি ভিসির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব। তবে রাকসু নির্বাচন দেয়ার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।’ তবে গতকাল বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

রাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবদুস সোবহান বলছেন- ‘ছাত্র সংগঠনগুলো চাইলে রাকসু নির্বাচন দিতে আমরা প্রস্তুত; কিন্তু যারা নির্বাচন করবে, সেই ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে ফ্রন্ট তৈরী করে নির্বাচনের পরিবেশ করতে না পারলে এ নির্বাচন হবে কিভাবে?’

রাকসু নির্বাচনের দাবিতে স্মারকলিপি প্রসঙ্গে জানতে চালে ভিসি আবদুস সোবহান বলেন, ‘দুই-একজন নেতাকর্মীদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এ দাবি মাঝে মাঝে আসছে; কিন্তু বড় সংগঠনগুলোকে তারা একত্রিত করতে পারছে না। এ কারণে তারা নির্বাচনী পরিবেশও তৈরী করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পরিবেশ তৈরী হলেই আমরা নির্বাচন দিতে প্রস্তুত আছি।’

স/আর