রক্তনালির ফিস্টুলা অস্ত্রোপচার ও ডায়ালাইসিস কখন করাবেন

কিডনি রক্তের সঙ্গে মিশে থাকা শরীরের দূষিত বর্জ্য পদার্থগুলো প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়। কিডনি তার কাজ ঠিকমতো না করলে এসব বর্জ্য রক্তে জমা হয় ও রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পৌঁছে তাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।  এ অবস্থাকে বলে ‘ইউরেমিয়া’ (Uremia)। ইউরেমিয়ার বিভিন্ন উপসর্গ আছে, যেমন দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা, রক্তশূন্যতা, বমিভাব ইত্যাদি। এ থেকে রোগী হঠাৎ অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। সুস্থ কিডনি ছাড়া সুস্থ শরীর সম্ভব নয়।

রক্তনালীর ফিস্টুলার অস্ত্রোপচার এবং ডায়ালাইসিস নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (ভাস্কুলার সার্জারি) ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার।

ডায়ালাইসিস কী

কৃত্রিম উপায়ে রক্ত পরিশোধনের একটি ব্যবস্থার নাম ডায়ালাইসিস।  কিডনি যখন ঠিকমতো কাজ করে না তখন বিকল্প হিসেবে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।  ডায়ালাইসিসের একাধিক প্রকারভেদ রয়েছে তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা হল হেমোডায়ালাইসিস।  এই পদ্ধতিতে শরীরের রক্তকে বাইরে নিয়ে আসা হয় ও যন্ত্রের মাধ্যমে পরিশোধন করে পুণরায় শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

ফিস্টুলা কী

ফিস্টুলা হল অপারেশনের মাধ্যমে তৈরি রক্তনালির এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যে শরীরের সব রক্তকে পর্যায়ক্রমে বাইরে নিয়ে আসা ও পরিশোধনের পর আবার শরীরের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া সম্ভব হয়।  ফিস্টুলাতে একটি ধমনি বা আর্টারির (Artery) সঙ্গে চামড়ার নিচের একটি শিরা বা ভেইনকে (Vein) অপরেশনের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয়।  এতে ধমনির উচ্চ চাপের রক্ত চামড়ার নিচের ওই শিরার ভেতরে প্রবেশ করে। রক্তের চাপে তখন ওই শিরাটি ফুলে মোটা ও এর দেয়াল পুরু হতে থাকে।  একে বলে ‘ম্যাচিউরেশন’।  একটা নির্দিষ্ট সময় পরে ফিস্টুলা ম্যাচিওর করলে এটি ডায়ালাইসিসের জন্য ব্যবহারযোগ্য হয়। তখন চামড়ার নিচের ফুলে ওঠা ওই শিরাতে মোটা সুঁচ ফুটিয়ে রক্ত বাইরে আনা ও পরিশোধনের পর ভেতরে ঢোকানোর কাজটি করা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে। হেমোডায়ালাইসিসের সময় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই রক্তকে শরীরের বাইরে নিয়ে এসে পরিশোধন করা সম্ভব হয়।

ফিস্টুলার স্থান ও প্রকারভেদ

সাধারণত একজন ডানহাতি ব্যক্তির জন্য বাম হাতের কব্জির সামান্য উপরে সামনের জায়গাটিকে ফিস্টুলা অপারেশনের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়। কারণ এ স্থানে তৈরি ফিস্টুলা ব্যবহার করা সবচেয়ে সুবিধাজনক। এখানে ব্যবহৃত ধমনির নাম রেডিয়াল ধমনি (Radial Artery) ও শিরার নাম কেফালিক ভেইন (Cephalic Vein)। রক্তনালির নামানুযায়ী এই ফিস্টুলাকে ‘রেডিও-কেফালিক ফিস্টুলা (Radio-Cephalic) নামে অভিহিত করা হয়। অবশ্য আবিষ্কারকদের নামানুযায়ী একে কখনও কখনও ’ব্রেসিয়া-কিমিনো’ ফিস্টুলা (Brescia-Cimino) ও বলা হয়ে থাকে। ফিস্টুলার জন্য সাধারণভাবে ব্যবহৃত দ্বিতীয় স্থানটি হল কনুইয়ের একটু উপরে সামনের দিকে। এই স্থানে দুই ধরনের ফিস্টুলা তৈরি করা সম্ভব। প্রথমত এবং তুলনামূলকভাবে সহজ ফিস্টুলাটির নাম ব্রাকিও-কেফালিক ফিস্টুলা (Brachio-Cephalic)। এখানে ব্যবহৃত ধমনির নাম ব্রাকিয়াল ধমনি ও শিরার নাম কেফালিক ভেইন। এখানে দ্বিতীয় আর যে ফিস্টুলাটি করা হয় তার নাম ‘ব্রাকিও-ব্যাজিলিক’ (Brachio-Basilic) ফিস্টুলা। এক্ষেত্রে কেফালিক ভেইনের অনুপযোগিতার কারণে বাহুর ভেতরের দিকের ব্যাজিলিক ভেইনকে ফিস্টুলা তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যাজিলিক ভেইনকে তার নিজস্ব গতিপথ থেকে তুলে এনে বাহুর সামনের দিকে চামড়ার নিচ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। তাই একে ‘ব্রাকিও-ব্যাজিলিক

ট্রান্সপজিশন ফিস্টুলা’ (Brachio-Basilic Transposition) ও বলা হয়ে থাকে। অনেক সময় শরীরের নিজস্ব কোনো শিরাই ফিস্টুলা তৈরির কাজে ব্যবহার উপযোগী থাকে না। সে ক্ষেত্রে কৃত্রিম রক্তনালি ব্যবহার করে ফিস্টুলা তৈরি করা সম্ভব।

ফিস্টুলা অপারেশন কে করেন, কীভাবে করেন

ফিস্টুলা তৈরির অপারেশনটি অতি সূক্ষ্ম একটি কাজ। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত একজন দক্ষ রক্তনালির বিশেষজ্ঞ সার্জন বা ভাস্কুলার সার্জনের পক্ষেই কেবল কাজটি সুচারুভাবে করা সম্ভব। সাধারণত ফিস্টুলা অপারেশনের জন্য রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না এবং অপারেশন শেষে রোগী বাড়ি চলে যেতে পারেন। অপারেশনের জায়গাটুকুকে স্থানীয়ভাবে অবশ করা হয় (Local Anesthesia) এবং রোগী সচেতন অবস্থায় থাকেন। তবে ট্রান্সপজিশন ফিস্টুলা বা কৃত্রিম রক্তনালি ব্যবহার করে ফিস্টুলা অপারেশনের ক্ষেত্রে পুরো হাত অবশ করে নেয়ার প্রয়োজন হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে অবশ্য রোগীকে অজ্ঞান করে অপারেশন করারও প্রয়োজন হতে পারে।

ফিস্টুলা অপারেশন সফল হলে অপারেশনে ব্যবহৃত শিরাটির উপরে এক ধরনের আওয়াজ তৈরি হয়। ঝিরঝির ধরনের এই শব্দটি সাধারণত হাত দিয়ে চামড়ার উপরে অনুভব করা যায়। একে ‘থ্রিল’ বলে। হাতে অনুভব করা না গেলেও এটি স্টেথোস্কোপ দিয়ে কানে শোনা সম্ভব।

ফিস্টুলা সংক্রান্ত জটিলতা

একটি অপারেশনে যেসব জটিলতা হওয়া সম্ভব, তার সবই ফিস্টুলার ক্ষেত্রে হতে পারে। সাধারণভাবে এগুলোর বেশিরভাগ হল ক্ষতস্থানে জীবাণু সংক্রমণজনিত বিষয়, যেমন ক্ষত না শুকানো, পুঁজ, পানি ঝরতে থাকা ইত্যাদি। কিন্তু ফিস্টুলা যেহেতু রক্তনালির বিষয় যেখানে উচ্চ চাপে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, তাই এক্ষেত্রে কিছু বিশেষ ধরনের জটিলতার কথা মাথায় রাখতে হয়। এগুলো মধ্যে রয়েছে- রক্তক্ষরণ (Bleeding), কখনও কখনও রক্ত জমা হয়ে চাকা তৈরি হতে পারে যাকে বলে হেমাটোমা (Hematoma)।

* অ্যানিউরিজম ও সিউডোঅ্যানিউরিজম (Pseudoaneurysm)- দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হচ্ছে এমন ফিস্টুলা অনেক সময় রক্তের চাপে ফুলে মোটা হয়ে আঁকাবাঁকা হয়ে যায়। একে অ্যানিউরিজম বলে। আবার অনেক সময় রক্তনালি জোড়া লাগানোর জায়গা আলগা হয়ে যাওয়ার কারণে অপারেশনের জায়গাটি ফুলে গিয়ে হৃৎপিণ্ডের ছন্দের সঙ্গে লাফাতে থাকে। একে সিউডোঅ্যানিউরিজম বলে। এটি কেবল অপারেশনের জায়গাতে নয়, ফিস্টুলার যে জায়গাতে সুঁচ ফুটিয়ে ডায়ালাইসিস করা হয়, সেখানেও হতে পারে।

* ফিস্টুলা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া। এটি সাধারণত জমাট রক্ত দিয়ে হয়।

* ‘স্টিল’- রক্ত ফিস্টুলায় বেশি প্রবাহিত হওয়ার কারণে হাতে রক্ত চলাচল কমে যাওয়া।

* ফিস্টুলায় রক্তের প্রবাহপথ সরু হয়ে যাওয়ার কারণে ডায়ালাইসিস ঠিকমতো না হওয়া। এ অবস্থাকে বলে ‘ফেইলিং ফিস্টুলা’ (Failing fistula)।

* হাত ফুলে যাওয়া- এটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে তবে বুকের ভেতরের বড় শিরাতে বাঁধার (ব্লক) সৃষ্টি হলে এটি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে, যা ‘সেন্ট্রাল ভেইন স্টেনোসিস’ (Central Vein Stenosis) নামে পরিচিত।

যদিও উপরোল্লিখিত জটিলতাগুলোর সবগুলোই চিকিৎসাযোগ্য, তবু কিডনি রোগীদের জন্য এগুলো বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করে যা অনেক সময় প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। তাই সতর্কতার সঙ্গে এসব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করাই বাঞ্ছনীয়।

 

সূত্রঃ যুগান্তর