যে কারণে বিচার হয় না ধর্ষণ মামলায়

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হলেও অবশেষে সেসব মামলার বিচার হয় না। এর পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন, দেশের নারীনেত্রী ও মানবাধিকারকর্মীরা। তারা জানিয়েছেন, অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি, তদন্তে দীর্ঘসূত্রীতা ও সাক্ষ্যগ্রহণের সময় ভিকটিমকে হয়রানির কারণেই ধর্ষণ মামলার কোনও বিচার হয় না।

তাছাড়া ধর্ষণের শিকার নারীকে আগের যৌন ইতিহাস নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করায় ৯০ ভাগ মেয়েশিশু ও নারী ধর্ষণ মামলার অভিযোগ আনতে ভয় পান। কেউ কেউ মামলা মাঝপথে বন্ধ করে দেন। অনেক সময় আসামিপক্ষের উকিলের জেরায় ভিকটিম নারী মানসিক ও সামাজিকভাবে ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েন।

এছাড়া ধর্ষণ মামলা পরিচালনায় তদন্তকারী কর্মকর্তা কেবল ফরেনসিক আলামতে মনোযোগ দিয়ে পারিপার্শ্বিক কোনও ঘটনা পরম্পরা না মেলানোয় মামলাগুলোর বিচার হচ্ছে না বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।

মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপের বরাত দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সালমা আলী বলেন, ‘নানা কারণে ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে থাকে। বিচার হয় না কারণ মানুষ স্বস্তি বোধ করে না। এছাড়া প্রভাবশালীরা সমঝোতা করে নেয় যেকোনোমূল্যে। অনেক মামলা আদালত পর্যন্ত যায় না, ফলে অপরাধী বারবার অপরাধ করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শারীরিক আলামত পাওয়া না গেলেও পারিপার্শ্বিক তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করা অসম্ভব কিছু নয়। তবে এজন্য দরকার সুষ্ঠু তদন্ত এবং তদন্ত প্রতিবেদন।  কিন্তু আমাদের তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে তত সময় বা আগ্রহ নেই।’

মানবাধিকার ও নারী অধিকার বিষয়ক সংস্থা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাব মতে, ২০১৬ সালে নভেম্বর পযন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৭৫ জন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৩৪ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩১ জনকে, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৪০ জনকে। ২০০১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা সহায়তা নিতে আসেন ২২ হাজার ৩৮৬ জন নারী৷ এর কুড়ি শতাংশ ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে যার মধ্যে রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ ভাগ৷

কেন বিচার হয় না বলতে গিয়ে নারীনেত্রী ও নিজেরা করি প্রতিষ্ঠানের প্রধান খুশি কবীর বলেন, ‘দুটোদিক আছে। একদিকে এমন সামাজিক পরিস্থিতি তৈরি করা হয় যেখানে মেয়েটি বিচার চাইতেই ভয় পাবে। দ্বিতীয়ত তার বিচারের জন্য যা যা আলামত ও সাক্ষ্য প্রয়োজন সেটি দুর্বল করে দেওয়ার কাজটি শুরু থেকেই করা হয়। ধর্ষণ যেহেতু ‘দুর্বলের’ ওপর সবলের ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার সেহেতু সব প্রমাণাদি ধবংস করে দিতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না।’

আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘আইনে অপরাধীকেই প্রমাণ করতে হবে যে সে অপরাধ করেননি, কিন্তু ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইনের কারণে এমনভাবে বিষয়টি পরিচালিত হয় ভিটটিমকেই বারবার তার ‘ইনোসেন্স’ প্রমাণ করতে হয়। এই হয়রানির ভেতর দিয়ে কোনও নারী নিজে বা তার পরিবার যেতে চান না বলেই মামলা না করা, মামলা উঠিয়ে নেওয়ার মতো বিষয়গুলো পরিসংখ্যানগত দিক থেকে অনেক বেশি ঘটে। আমাদের মূল সমস্যা সাক্ষ্য আইন। মনে রাখতে হবে সাক্ষ্য শুরু মানে বিচার শুরু। সেটি যদি দুইতিনশ বছর আগের প্রেক্ষিতের তৈরি হয়, এখন কি করে তা আপনি মানানসই করে তুলবেন?’

তিনি আরও বলেন, ‘অনেকসময় বলা হয়, যার অপরাধ তাকেই প্রমাণ করতে হলে ‘ফাঁসিয়ে দেওয়া’র সুযোগ তৈরি হতে পারে। এসবক্ষেত্রে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা মোটেই কঠিন কিছু না। কোনও ভিকটিমের মানসিক অবস্থা বিবেচনার কথা কোনও আইনে সুনির্দিষ্ট করা হয় না। আমাদের এখানে ভিকটিম সাপোর্ট বলে আসলে কিছু দাঁড়ায়নি।’

এদিকে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবীর সদস্য অ্যাডভোকেট দিলরুবা শারমীন বলেন, ‘নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে যখন জবানবন্দি দেন, সেটিই সবচেয়ে বড় সাক্ষী এবং আর কোনও তথ্যউপাত্ত প্রয়োজন হয় না। তিনি সত্য না মিথ্যা বলছেন সেটি জবানবন্দি থেকেই বুঝা সম্ভব।  উচ্চ আদালতের অনেক মামলার রায়ে ও পর্যবেক্ষণে বলা আছে, জবানবন্দিই এক্ষেত্রে যথেষ্ট। যদি মেডিক্যাল টেস্টের সময় পার হয়ে যায় সেক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক প্রমাণ দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করতে তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়।’  সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন