যুগ যুগ ধরেই আরডিএ’র প্লট নিয়ে চলছে বাণিজ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক: ১৯৭৬ সালে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই নানা বিতর্ক জন্ম দিয়ে আসছে প্লটসহ স্থাপনা নির্মাণের মধ্য দিয়ে। বলা যায়, আরডিএর শুরু থেকেই লটারির নামে বরাদ্দকৃত প্লট নিয়ে চলছে হরিলুট। ফলে সাধারণ মানুষ প্লট থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে আরডিএর কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা, ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী অথবা প্রভাবশালীদের দখলে যাচ্ছে সরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা এসব আবাসন এলাকা।

বিশেষ করে প্লট বরাদ্দের নামে এখানকার কর্মকর্তাদের বড় ধরনের বাণিজ্য করার অভিযোগ আছে। আরডিএতে দায়িত্বরত অবস্থায় যখনই প্লট বরাদ্দ হয়, তখনই চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এস্টেট কর্মকর্তা, অথরাইজড কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন অন্তত ১০ জন কর্মকর্তার দখলে যায় প্লট।

আলম হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলছিলেন, রাজশাহী নগরীর ভদ্রা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা তিনি। নিজের একটি ডেন্টাল ক্লিনিকও আছে। তবে এখনো মাথা গোঁজার জন্য আপন ঠিকানা গড়তে পারেননি। পরিবার নিয়ে থাকতে হয় ভাড়া বাড়িতেই। একসঙ্গে জমি কিনে বাড়ি করবেন, সেই সামার্থ্যও নেই তাঁর। তাই কয়েক বছর ধরে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) একটি প্লট পাওয়ার আশায় ঘুরছেন। সর্বশেষ বনলতা আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় নিজের একটি আবাসন গড়ে তোলার জন্য আরডিএর সাড়ে তিন কাঠার একটি প্লট পেতে আবেদন করেছিলেন। তবে এবারও তাঁর কপালে প্লট জোটেনি।

শুধু তিনি নন, তাঁর মতো রাজশাহীর এমন হাজার হাজার মানুষ আরডিএর একটি প্লটের আশায় ঘুরছেন বছরের পর বছর ধরে। প্লট বরাদ্দের নোটিশের খবর পেয়ে দুই-আড়াই হাজার টাকা দিয়ে আবেদনপত্র সংগ্রহের পর ব্যাংকে জামানত দিয়েও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত প্লট। বরাদ্দ শেষে দেখা যায় সব প্লট পেয়ে গেছেন প্রভাবশালীরা, যাঁদের বেশির ভাগেরই নগরীতে একাধিক বাড়ি কিংবা প্লট রয়েছে। পরে তাঁরা আরডিএর সেই প্লট বেশি দামে অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেন। অনেকে সেখানে নতুন করে বাড়িও করেন। এভাবে যুগ যুগ ধরেই আরডিএর প্লট হরিলুট হয়েছে।

সর্বশেষ আরডিএ ৩১টি প্লট বরাদ্দ নিয়ে বড় ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এই প্লটগুলোর মধ্যে অন্তত ১৮টি নিজেদের মধ্যে নামে-বেনামে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন আরডিএর কর্মকর্তারা। মাত্র চার-পাঁচটি ছাড়া বাকি প্লটগুলো দেওয়া হয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে রাজশাহীর স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ নিয়ে গত মঙ্গলবার কালের কণ্ঠে ‘৩১ প্লটের ১৮টিই নিজেরা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

এর আগেও রাজশাহীর পদ্মা আবাসিক এলাকা বনলতা আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় প্লট বরাদ্দের অনিয়মের কারণে তৎকালীন এস্টেট কর্মকর্তা বর্তমানে অথরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুদক।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহীতে প্রথমে ১৯৯২ সালে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নেয় আরডিএ। ওই সময় বরাদ্দ দেওয়া ৫৬৫টি প্লটের এখনো এক-তৃতীয়াংশে বাড়ি-ঘর গড়ে ওঠেনি। আবার কমিউনিটি সেন্টারের কথা বলে পানির দামে দেওয়া ১৮ কাঠার একটি প্লটে এখনো গড়ে ওঠেনি কমিউনিটি সেন্টার। ওই প্লটটি পরে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে ঢাকার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে। তারা বর্তমানে ওই স্থানে কমিউনিটি সেন্টার কাম আবাসিক ভবন গড়ে তুলছে।

সে সময় এই আবাসিক প্রকল্পে যাঁরা প্লাট পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন আরডিএর কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ, তৎকালীন মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালীরা। যাঁদের মধ্যে পরে প্লটগুলো কয়েক দফা হাত বদল হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, পদ্মা আবাসিক প্রকল্প গ্রহণের ঠিক এক বছর পরই তার পাশেই গড়ে তোলা হয় পারিজা আবাসিক প্রকল্প। পদ্মা আবাসিকের কারণে যাঁরা জমি হারিয়েছিলেন তাঁরা তার পাশেই বাড়ি করার আশায় ছিলেন। তবে পারিজা প্রকল্পের কারণে সেখান থেকেও উচ্ছেদ হতে হয় স্থানীয়দের। ৫৬টি প্লটের এই প্রকল্পেও সেই সময় মহা দুর্নীতি হয় বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়।

এরপর ১৯৯৫ সালে গড়ে তোলা হয় বনলতা বাণিজ্যিক প্রকল্প। ৯৭টি প্লটের এ প্রকল্পে পরে অর্থের বিনিময়ে গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া হয় আবাসিক এলাকা। সেখানে একই প্লট একের পর এক হাত বদল হয়ে এখন কাঠাপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০ লাখ টাকা করে। অথচ বরাদ্দ দেওয়ার সময় এটির মূল্য ধরা হয়েছিল প্রতিকাঠা মাত্র দেড় লাখ টাকা করে।

আব্দুস সালাম নামের এক ব্যক্তির প্লটটি সর্বশেষ বিক্রি করা হলো আবাসিক হিসেবে। আরডিএর এ্যাস্টেট কর্মকর্তা বদরুদ্দজাকে ম্যানেজ করে প্রতি কাঠা বিক্রি করা হয়েছে ১৫ লাখ টাকা করে। এ নিয়ে দুই বার হাত বদল হওয়া এ প্লটটি নিয়ে মোটা অঙকের অর্থ আদায় করা হয় প্ল মালিকদের নিকট থেকেো।

১৯৯৭ সালে আরডিএ ভদ্রা এলাকায় ২২৪টি প্লট নিয়ে ছায়ানীড় প্রকল্প, ২০০৬ সালে ৪০০টি প্লট নিয়ে গড়ে তোলা চন্দ্রিমা আবাসিক প্রকল্প, ২০১০ সালে ১১০টি প্লটের মহানন্দা আবাসিক প্রকল্প নিয়েও রয়েছে দুর্নীতির নানা অভিযোগ।

২০১৩-১৬ সালের মেয়াদ ধরে ২৪২টি প্লট নিয়ে প্রান্তিক আবাসিক প্রকল্প, ২০১০-১৬ সালের মেয়াদ ধরে ২০৫টি প্লটি নিয়ে বারনই আবাসিক প্রকল্প এবং ২০০৯-১৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদ ধরে বনলতা বাণিজ্যিক এবং আবাসিক প্রকল্প নিয়েও রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ।

এগুলোর মধ্যে বারনই প্রকল্পের জন্য এরই মধ্যে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু জমি এখনো অধিগ্রহণ করতে পারেনি আরডিএ। শুধু নোটিশ করেই বিষয়টি রেখে দিয়েছে তারা। ফলে জমির মালিকরা এখনো ক্ষতিপূরণ না পেয়ে চরম হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন মোজাফফর হোসেনসহ আরো অনেক জমির মালিক।

তাঁদের অভিযোগ, জমি অধিগ্রহণ না করেই আরডিএ তাঁদের জমি কেড়ে নিয়েছে। প্লটগুলোও বরাদ্দ দিয়েছে। ওই সব জমিতে তাঁরা এখন আর নামতে পারছেন না। ফলে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন তাঁরা। অথচ এসব প্লট দেওয়া হয়েছে পছন্দের লোকদের মধ্যে।

অভিযোগ রয়েছে, বনলতা ও মহানন্দা বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে কিছু অংশ পড়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগের (হাউজিং এস্টেট) মধ্যে। ফলে ওই দুটি এলাকার প্লটগুলো এখনো রেজিস্ট্রি দিতে পারছে না আরডিএ। তাঁদের কাছ থেকে জমি বুঝে না নিয়েই প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্লটের কিস্তিও পরিশোধ করেছেন প্লট মালিকরা। আবার অনেকেই কয়েক দফা হাত বদলও করেছেন এরই মধ্যে। কিন্তু আরডিএ তাদের কাউকেই জমি নিবন্ধন করে দিতে পারেনি হাউজিং এস্টেটের সঙ্গে ঝামেলা থাকার কারণে।

আবার মুনির হোসেন নামের এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, ‘আবেদনকারীদের মধ্যে প্লট না পাওয়া যাঁরা জমাকৃত জামানত (বিডি) ফেরত নিতে যান, তাঁদের সঙ্গে সঙ্গেই জামানত ফেরত দেওয়া হয় না। অন্তত দুই বছর ধরে তাঁদের নানাভাবে ঘোরানো হয়। এরপর দেওয়া হয় ব্যাংকের চেক। আর মাঝের সময়টায় টাকাগুলো আরডিএর ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তার ব্যক্তিগত হিসাবে ফিক্সড ডিপোজিড করে রাখা হয়। ফলে সেখান থেকে দুই বছরে বিপুল অঙ্কের সুদ পান তাঁরা। এভাবেও প্লট বরাদ্দের নামে আবেদন নিয়ে সাধারণ মানুষের অর্থ নিয়ে হয়রানি করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, দেশের বাইরে থেকে যাঁরা আবেদন করেন, তাঁদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ডলার। কিন্তু ফেরত দেওয়ার সময় তাঁদের দেওয়া হয় টাকা। এতে করেও হয়রানির শিকার হন আবেদনকারীরা।

এসব অনিয়ম নিয়ে গতকাল আরডিএর এস্টেট কর্মকর্তা বদরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নই। আপনারা যা ইচ্ছে তাই পত্রিকায় লিখে দেন। এসব নিয়ে আমাদের কিছু যায়-আসে না।

আরডিএর চেয়ারম্যান বজলুর রহমান দেশের বাইরে থাকায় এসব বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

স/আর