মেস ভাড়া ও ফি নিয়ে হুমকিরমুখে রাজশাহীর লাখো শিক্ষার্থীর পড়া-শোনা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া-শোনা করেন শারমিন আক্তার। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্টান বন্ধ থাকলেও ক্যাম্পাস থেকে শেসন ফি জমা দিতে বার বার ফোন করা হচ্ছে। সেশন ফি সময় মতো না দিলে অতিরিক্ত চার্জ দিতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর। আর টাকা না দিতে পারলে অংশ নিতে দেওয়া হবে না পরীক্ষায়। এর ওপর রয়েছে মেস ভাড়া।’

তিনি বলেন, আমার বাবা একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। করোনার কারণে তাঁর ব্যবসাও বন্ধ। এখন সংসার চালানোয় দায়। এই অবস্থায় সেশন ফি দিব না মেস ভাড়া দিবে সেই চিন্তাই বাড়িতে বসে থেকে ঠিকমতো পড়া-শোনাও করতে পারছি না। এই অবস্থায় সরকার আমাদের কথা বিবেচনা করে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন ও মেসভাড়া মৌকুফের ঘোষণা না দিলে হয়তো পড়া-শোনায় বন্ধ হয়ে যাবে ভবিষ্যতে।’

সাব্বির হোসেন। রাজশাহীর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। থাকেন নগরীর পাঠানপাড়া এলাকার একটি মেসে। করোনা আতঙ্কের কারণে গত ১৬ মার্চ থেকে স্কুল-কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর ১৭ মার্চ বাড়ি চলে যান তিনি। তার পর থেকেই বাড়িতেতই অবস্থান করছেন। রাজশাহীতে থাকা অবস্থায় পড়া-শোনার পাশাপাশি টিউশনি করে মেসভাড়াসহ আনুসঙ্গিক খরচ জোগাড় করতেন তিনি।

মধ্যবিত্ত পরিবারের এই শিক্ষার্থী বাড়িতে চলে যাওয়ায় এখন টিউশনি বন্ধ হয়ে আছে। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না থাকায় এখনো বাড়িতেই থাকছেন। কিন্তু মেস থেকে মাঝে-মধ্যেই ফোন দিয়ে মেস ভাড়ার জন্য ফোন দিচ্ছেন মেস মালিক। মেস মালিকের কথা, ‘মেস ভাড়া পরিশোধ করে যেতে হবে। পরিশোধ না করলে যখন মেসে আবার আসবেন, তখন সবগুলো টাকা পরিশোধ করতে হবে একসঙ্গে।’

সাব্বির হোসেন বলেন, ‘মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে এই দুর্যোগকালীন আমাদের সংসার চালাতেই কষ্ট হচ্ছে। এর ওপর মেসভাড়া এখন পরিশোধ করবো কি করে। মেসের একটি কক্ষে থাকি ২জন। পত্যেককে প্রতি মাসে ভাড়া দিতে হয় ২ হাজার টাকা করে। সেই হিসেবে দুই মাসের ভাড়া বকেয়ে পড়েছে আমার চার হাজার টাকা। এই টাকা এখন দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আবার সেপ্টেম্বরে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে, তখন এই ভাড়া গিয়ে ঠেকবে ১২ হাজার টাকায়। তখন এতো টাকা পাবো কোথায়? এই অবস্থায় মেসভাড়ার চিন্তায় অনেক সময় কাটছে। রাতে কখনো কখনো ঘুমাতেও পারি না।’

শুধু এই দুই শিক্ষার্থীই নয়, অনুসন্ধানে জানা গেছে, তাঁদের মতো শিক্ষা নগরী রাজশাহীর অন্তত দুই লাখ শিক্ষার্থী এবং তাঁদের অভিভাবক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেতন ও মেসভাড়া নিয়ে এখন চরম দুশ্চিন্তায় দিনাতিপাত করছেন। বিশেষ করে বেসরকারী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মাসিক বেতন বা সেশন ফি পরিশোধ ও মেসভাড়া পরিশোধ নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন। কারণ সরকারি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন বা সেশন ফি কয়েক গুন থেকে শুরু ককরে কয়েক শ গুন বেশি। ফলে দেশের এই দুর্যোগকালীন সময়ে যেখানে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর সংসার চালানোয় কষ্টকর হয়ে পড়েছে সেখানে রাজশাহীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়া-শোনা করা প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে অধিকাংশরই প্রতিষ্ঠানের বেতন ও মেস ভাড়া পরিশোধ যেন গলার কাটা হয়ে বিধে গেছে এখন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিক্ষা নগরী রাজশাহীতে রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সরকারি কলেজ, সরকারি-বেসরকারী মিলে চারটি মেডিক্যাল কলেজ ৬টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দুটি সরকারি পলিটেকনিকসহ দুই শতাধিকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় চার লাখ।

যাদের মধ্যে অন্তত দুই লাখ শিক্ষার্থীর ঠাঁই হয়েছে এই শহরের প্রধান সড়কের পাশ থেকে শুরু করে অলি-গলির মধ্যে গড়ে উঠা মেসে। আর অন্তত এক লাখ শিক্ষার্থী আছেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আবার অনেকেই বাড়ি ভাড়া নিয়েও বাবা-মার সঙ্গে শুধু পড়া-শোনার জন্য গ্রাম-বা বিভিন্ন বিভিন্ন জেলা শহর থেকে এসে রাজশাহী শহরে বসবাস করে। ফলে গত মার্চ থেকে স্কুল-কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি হয়ে যাওয়ার পরে অন্তত তিন লাখ শিক্ষার্থী ও অনেক শিক্ষার্থীর পরিবার এই রাজশাহী শহর ছেড়েছেন।

রাকিব হোসেন নামের এক শিক্ষার্থী সিল্কসিটিনিউজকে বলেন, ‘আমি যে মেসে থাকি সেখানে রয়েছে কম্পিউটারসহ বিছানা-পত্র ও বইপত্র। মেস ছেড়ে দিতে চাইলেও ভাড়া পরিশোধ না করলে মেস থেকে এখন সেগুলো আটকে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ভাড়া পরিশোধ করেই মেস থেকে সেগুলো নিয়ে যেতে বলা হয়েছে।’

দুর্গাপুরের আলমগীর হোসেন সিল্কসিটিনিউজকে বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে রাজশাহীর দুটি কলেজে পড়ে। আমি মুহরিবারে দলিল লিখে কোনো মতে সংসার চালানোর পাশাপাশি তাদের খরচ দেয়। এখন মুহরিবার বন্ধ হয়ে আছে। আমার আয়ও নাই। কিন্তু মেস থেকে ভাড়া টাকার জন্য বার বার ফোন করা হচ্ছে। আবার এক মেয়ে যে বেসরকারি কলেজে পড়ে সেখানেও খোলার পরে দিতে হবে মাসিক বেতন ও পরীক্ষার টাকা। তাহলে এতো টাকা আমি পাবো কোথায়। ওইসময় টাকা দিতে না পারলে হয়তো মেয়ের পড়া-শোনায় বন্ধ হয়ে যাবে। এই অবস্থায় সরকারের উচিত জরুরীভাবে মেসভাড়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সকল বেতন মকুফের ঘোষনা দেওয়া। না হলে অনেক শিক্ষার্থীর পড়া-শোনা বন্ধ হয়ে যাবে। টাকার ওভাবে যারা রাজশাহীর বাইরে থেকে শহরে গিয়ে পড়া-শোনা করে তাদের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী হয়তো অনেকেই রাজশাহীতেই যাবে না।’

এদিকে রাজশাহী রাজশাহীর মেসভাড়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন মকুফের দাবিতে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকেও সক্রিয় হয়ে উঠছে শিক্ষার্থীরা। তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগ ও জেলা ছাত্রলীগেরও অনেক নেতা।

জানতে চাইলে রাজশাহী মেস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, মেসভাড়া মৌকুফ করলে তো আমরাও বিপাকে পড়বো। কারণ অনেকেই এই মেসভাড়া থেকেই সংসার চালান। আবার অনেকের ব্যাংক লোন নিয়ে বাড়ি করা হয়েছে। তারা সেই লোন পরিশোধ করেন মেস ভাড়া থেকে। তাহলে আমরা যাবো কোথায়।’

তবে রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ হবিবুর রহমান সিল্কসিটিনিউজকে বলেন, দেশের এই দুর্যোগকালে মেসভাড়া মওকুফ জরুরী। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়বেন আরো বেশি। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন মওকুফ জরুরী। না হলে অনেকের পড়া-শোনা হুমকির মধ্যে পড়বে।’

স/আর

আরও পড়ুন:

রাজশাহী কলেজের হোস্টেল ভাড়া স্থগিত করলেন অধ্যক্ষ