মিত্রদের সঙ্গে বোঝাপড়া চলছে আওয়ামী লীগের

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথের আন্দোলনে থাকলেও আওয়ামী লীগে চলছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে ক্ষমতাসীন দলটির আসনভিত্তিক প্রার্থী বাছাইয়ে সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভা। নৌকার টিকিটপ্রত্যাশী নেতারাও অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন এ সভার দিকে।

তিন দিনব্যাপী এ বৈঠকের প্রথমদিন রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে ৬৯টি আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে দলটি। যদিও মনোনীতদের নাম ঘোষণা করা হয়নি। আগামীকাল শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে সব আসনে মনোনয়নপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হবে। এর পাশাপাশি শরিক দলগুলোর সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়েও চলছে আওয়ামী লীগের আলোচনা।  ৯টি রাজনৈতিক দলের ১৪ নেতার একটি প্রতিনিধি দল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের নানা অঙ্ক মাথায় রেখেই চলছে আওয়ামী লীগের আসনভিত্তিক নিজ দলীয় প্রার্থী বাছাই।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে চলছে দলটির মনোনয়ন বোর্ডের সভা। এতে সভাপতিত্ব করছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মনোনয়ন বোর্ডের প্রধান শেখ হাসিনা। গতকাল প্রথম দিনের সভাশেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বোর্ডের সদস্য সচিব ওবায়দুল কাদের জানান, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের কিছু আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে কারা বাদ পড়েছেন, তা প্রকাশ না করে তিনি বলেন, বেশ কয়েকজন বর্তমান সংসদ সদস্য বাদ পড়েছেন। আগামী শনিবারের (আগামীকাল) মধ্যে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হবে। আমাদের সংসদীয় বোর্ড আজ দুটি বিভাগ, রংপুরের ৩৩টি ও রাজশাহীর ৩৬টি মিলে মোট ৬৯টি আসনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা সব আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত ফল প্রকাশ করব না। একসঙ্গে আমাদের সব মনোনয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করব। আজ শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্ত মনোনয়ন বোর্ডের সভা মুলতবি করা হয়েছে, জানান তিনি।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, বোর্ডে যেসব প্রার্থীর (রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ) বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে রাজনীতির বাইরের কেউ বিবেচিত হয়েছেন বলে আমার জানা নেই। বিদ্রোহী প্রার্থী প্রসঙ্গে করা এক প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, আগে আমরা দেখি কারা বিদ্রোহী হয়, তারপর সিদ্ধান্ত নেব। তিনি বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে সারাদেশে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। জোট হবে বিভিন্নভাবে। কার সঙ্গে কার জোট হবে, কোথায় গিয়ে ঠেকবে বলা মুশকিল।

এদিকে একই সময়ে বিএনপির গতিবিধি লক্ষ রেখে দলের কৌশল নির্ধারণ করেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ১৪ দলসহ মিত্রদের সঙ্গে বোঝাপড়া করছে। ১৪ দলসহ আওয়ামী লীগের মিত্র দলগুলো এরই মধ্যে দলীয় ফরম বিতরণ করে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে না এলে সমঝোতার ভিত্তিতে জোটের শরিকদের মধ্যে আসন বণ্টন বা সমঝোতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

যদিও বৃহস্পতিবার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সবাইকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এরই মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যেসব দল, সেসব দলকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, যারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন আমি আপনাদের সবাইকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ, আগামী সাধারণ নির্বাচন যে অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৮টি দলই ভোটের লড়াইয়ে নামার কথা জানিয়েছে। ভোটে যাবে না বলেছে বিএনপিসহ ১৫টি রাজনৈতিক দল। একটি দল আগামীকাল তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে বলে এর আগে আমাদের সময়কে জানিয়েছে।

বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি তিনশ আসনে মনোনয়ন ফরম ছেড়েছে। শুক্রবারও ফরম বিক্রি অব্যাহত থাকবে তাদের। খুব শিগগিরই প্রার্থী বাছাইয়ের দিকে যাচ্ছে দলটি। এছাড়াও ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূল বিএনপি। নির্বাচনে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম এল), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), গণফোরাম, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, বাংলাদেশ কংগ্রেস, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জাকের পার্টি এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ করছে। এই দলগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ আওয়ামী লীগের সঙ্গে অদৃশ্য সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে যাবে। নির্বাচন হলে তারা সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, এমনটাই ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

উল্লিখিত জোটের একটি দলের নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আমরা ভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আওয়ামী লীগ আহ্বান জানালে তাদের সঙ্গে নির্বাচনী জোটে থেকে ভোট করব। না চাইলে সমঝোতার ভিত্তিতে পৃথকভাবে নির্বাচন করব।

তবে জাতীয় পার্টিসহ বেশকিছু দল আলাদাভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকার মনোভাব নিয়েই এগোচ্ছে।

নির্বাচন সুষ্ঠু হলে জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে- এমন আশাবাদ জানিয়ে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, আশা করছি, নির্বাচন কমিশনসহ যারা আশ্বস্ত করেছেন তারা কথা রাখবেন। বিশ্বাস করা ছাড়া তো উপায় নেই। জনগণ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে জাপা।

দলটির আরেকটি পক্ষ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনের পথে যাচ্ছে। হিসাব চূড়ান্তভাবে না মেলায় এখনো তারা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেননি। তবে কিছু বিষয়ে ছাড় দিয়ে এ সপ্তাহের মধ্যেই একটা সমাধান হয়ে যাবে বলে দলটির কেন্দ্রীয় এক নেতা জানান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চৌদ্দ দলের শরিকদের মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ৩০ আসনে দলীয় ফরম বিক্রি করেছে। তবে প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি এখনো। দলটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা করে জোটের প্রার্থী বাছাই করা হবে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গত নির্বাচনের তুলনায় এবার বেশি আসন চাইবে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সারাদেশে ৪২৬টি ফরম বিতরণ করেছে। প্রার্থীদের নাম যে কোনো সময় ঘোষণা হবে। তবে জোটের কাছে তারা ১০টি আসন চাইবে বলে জানা গেছে। এছাড়াও দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল তাদের ১০ নেতাকে ফরম বিতরণ করেছে।

দিলীপ বড়ুয়া জানান, জোটের কাছে তিনি ১টি আসন চাইবেন। তরিকত ফেডারেশন ১৫০ আসনে দলীয় ফরম বিতরণ করেছে। ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী জানান, তিনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনে যাবেন। এর বিকল্প তার ভাবনা নেই। জোটের কাছে তিনি ১৫টি আসন চাইবেন। তিনি জানান, আসন নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা না হলেও জোটে কথাবার্তা হচ্ছে।

এদিকে গণ-আজাদী লীগ ও বাসদ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছে। এছাড়া গণতন্ত্রী পার্টি ১০-১২ আসন চাইতে পারে। কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, ন্যাপসহ জোটের অন্যসব দল ৬-৮টি আসন চাইতে পারে। আসন বণ্টন নিয়ে শিগগিরই বৈঠক হবে বলে জানিয়েছেন গণ-আজাদী লীগের নেতা অ্যাডভোকেট এসকে শিকদার।

জোট মহাজোটের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব) ফারুক খান বলেন, চৌদ্দ দল একসঙ্গে নির্বাচন করবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী মহাজোট হবে কিনা তা এখনই বলা যাবে না।

এদিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গতকাল ৯টি রাজনৈতিক দলের ১৪ জন নেতার একটি প্রতিনিধি দল গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। দলগুলো হলো- বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, আশেকানে আউলিয়া ঐক্য পরিষদ এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

এসব দলের প্রতিনিধিরা আসন্ন নির্বাচনের সার্বিক বিষয় নিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেন। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের জন্য তারা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান এবং তার নেতৃত্বে দেশে ব্যাপক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন। পরে প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে একটি ক্যালিওগ্রাফি উপহার দেওয়া হয়।