মারমুখি আচরণেই অভ্যস্ত রাজশাহী চিনিকলের প্রকৌশলী সামিউল


নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজশাহী চিনিকলের এক প্রকৌশলী তুই তুকারি করে কথা বলতেই পছন্দ করেন। দিনের পর দিন তিনি অফিসের সহকর্মী ও অধীনস্থ কর্মচারীদের এভাবে কথা বলেন। করেন মারমুখী আচরণও। চিনিকল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে পর্যন্ত তিনি তুই তুকারি করে কথা বলেছেন। প্রধান শিক্ষক লিখিতভাবে বিষয়টি অবহিত করলেও কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

সবশেষ গত ২৪ মার্চ চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদককে তুই তুকারি করে কথা বলেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, রড দিয়ে শ্রমিক নেতার হাতের আঙ্গুলও ফাটিয়েছেন তিনি। ঘটনাটি তদন্ত করে তাঁর কাছে কৈফিয়ত তলব করেছেন চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল বাশার। শুক্রবার এই চিঠি ইস্যু করা হয়।

তদন্তে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ

তিন কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত

অভিযুক্ত প্রকৌশলীর কাছেও কৈফিয়ত তলব

সামিউল ইসলাম রাজশাহী চিনিকলে সহকারী ব্যবস্থাপক (সিভিল) পদে কর্মরত। গত ২৪ মার্চ চিনিকল সিবিএর সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামকে মারধরের ঘটনায় চিনিকল কর্তৃপক্ষ চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে দেয়। বৃহস্পতিবার কমিটি তদন্ত শেষ করে এমডির কাছে প্রতিবেদন দেয়। এর প্রেক্ষিতে সামিউল ইসলামের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হয়।

এছাড়া সিবিএ সভাপতি মাসুদ রানা ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলামের কাছেও কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে। তাদের সাতদিনের মধ্যে লিখিতভাবে জবাব দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামিউলের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেন তিন কর্মচারী। এ জন্য তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হলেন- টারবাইন অপারেটর সোহেল রানা, খালাসি আলমগীর হোসেন ও হিসাব শাখার অফিস সহায়ক মুরাদুল ইসলাম।

সহকারী ব্যবস্থাপক (সিভিল) সামিউল ইসলামের কৈফিয়ত তলবের চিঠিতে বলা হয়েছে, চিনিকলের টারবাইন অপারেটর সোহেল রানার কোয়ার্টারে পানির সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলে সামিউল ইসলাম সিবিএ সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। তিনি শ্রমিক নেতাকে উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলেন এবং শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেন। কাজের অগ্রগতির বিষয়টি সুন্দরভাবে বুঝিয়ে না দিয়ে এমন আচরণ করে তিনি অপেশাদার আচরণ করেছেন। বিষয়টি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

শ্রমিকেরা জানান, সবার সঙ্গে এমন আচরণই করে থাকেন সহকারী ব্যবস্থাপক সামিউল ইসলাম। বিভিন্ন সময় তিনি শ্রমিকদের সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন। বছরখানেক আগে চিনিকল সংলগ্ন হরিয়ান বাজারে কাঠ ফাঁড়াই করতে গিয়ে এক স’মিলে চিনিকলের এমএলএসএস মনসুর আলীর সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন সামিউল। অন্য শ্রমিকেরা তাঁকে সামিউলের হাত থেকে রক্ষা করেন। মাস ছয়েক আগে চিনিকলের যান্ত্রিক প্রকৌশল প্রধান মেসবাউল ইসলামের সঙ্গেও মারমুখী আচরণ করেন তিনি। সেদিন চিনিকলে নতুনের জায়গায় পুরাতন বোরিং পাম্প ও পাইপ বসাচ্ছিলেন প্রকৌশলী সামিউল। মেসবাউল ইসলাম এই অনিয়মের প্রতিবাদ করলে সামিউল তাঁর সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন।

রাজশাহী চিনিকলের অধীনেই পরিচালিত হয় চিনিকল উচ্চবিদ্যালয়। প্রকৌশলী সামিউল এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসলাম আলীর সঙ্গেও তুই তুকারি করে কথা বলেছেন। শুক্রবার দুপুরে আসলাম আলী বলেন, ‘বছরখানেক আগে স্কুলে একটি কাজ চলছিল। এক সকালে প্রকৌশলী সামিউল ফোন করে বলেন, “এই হেড মাস্টার সাহেব আপনি কোথায়?” আমি বলি, আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? এ সময় তিনি বলেন, “তোর সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে?” তুই তুকারি করে আরও অনেক খারাপ কথা বলেন তিনি। আমি একটি নোট দিয়ে বিষয়টি চিনিকলের এমডিকে জানাই। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সামিউলের ব্যবহার অত্যন্ত খারাপ। সবার সঙ্গেই এ রকম আচরণ করেন।’

প্রকৌশলী সামিউল ইসলাম শুক্রবার দুপুরে বলেন, তিনি এখনও কৈফিয়ত তলবের চিঠি পাননি। চিঠি পেলে জবাব দেবেন। অধীনস্থদের সঙ্গে মারমুখী আচরণের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। প্রধান শিক্ষককে তুই তুকারি করার প্রসঙ্গ তুলতেই ‘তাঁর সঙ্গে কিছুই হয়নি’ বলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।

চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাসুদ রানা বলেন, ‘সংস্কার খাতে প্রতি অর্থবছরে চিনিকলে প্রায় ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। এগুলোর বেশিরভাগ অর্থই ভুয়া ভাউচারে নয়ছয় করেন প্রকৌশলী সামিউল ইসলাম। তিনি চিনিকলের এমডিকেও তছরুপ করা অর্থের ভাগ দেন। এ জন্য এমডি সামিউলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না। রফিকুলকে মারধরের ঘটনায় এমডি শ্রমিক প্রতিনিধি ছাড়াই নিজেদের কর্মকর্তাদের নিয়ে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করেন। নিজেদের মতো করে তদন্ত প্রতিবেদন করে সামিউলকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। উল্টো “শায়েস্তা” করতে তিন কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং আমি এবং আমার সাধারণ সম্পাদক রফিকুলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।’

সিবিএ সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাকে রড দিয়ে মেরে আঙ্গুল কেটে দিয়েছেন সামিউল। এ ঘটনায় এমডির কাছে সংগঠনের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ করেছি। কিন্তু এ অভিযোগের তদন্ত হয়নি। সামিউল উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন। সেই অভিযোগ তদন্ত করে তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের এমন পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের কারণে চিনিকলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।’

জানতে চাইলে চিনিকলের এমডি আবুল বাশার বলেন, ‘রফিকুল সিবিএ নেতা পরে, আগে আমার কর্মচারী। তিনি তাঁর বিভাগের মাধ্যমে অভিযোগ না করে সংগঠনের পক্ষ থেকে করেছেন। এ জন্য তাঁর অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি।’ সামিউলের তুই তুকারি করে কথা বলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্কুলের প্রধান শিক্ষক একটা নোট দিয়েছিলেন। আমি তাদের মীমাংসা করে দিয়েছিলাম। আর সামিউলের বদলির জন্য মৌখিকভাবে ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম। কিন্তু বদলি করা হয়নি। এরমধ্যে এবার শ্রমিক নেতার সঙ্গে ‘অপ্রীতিকর’ ঘটনা ঘটল।’ সংস্কার কাজে অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সব কাজ স্বচ্ছভাবেই হয়।’

গত ২৪ মার্চ শ্রমিক নেতা রফিকুল ইসলামকে মারধরের ঘটনায় তিনি রাজশাহীর কাটাখালী থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তবে ঘটনাটি সরকারী প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরণীণ বিষয় বলে অভিযোগের তদন্ত করছে না পুলিশ। তবে ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সচিব চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার মহাব্যবস্থাপক (পরিদর্শন ও তদন্ত) আকুল হোসেনকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছেন। কমিটির দুই সদস্য হলেন- ব্যবস্থাপক (সংস্থাপন) সাইফুল ইসলাম ও উপব্যবস্থাপক (পুরকৌশল) শাহিনুল ইসলাম। শুক্রবার তদন্ত কমিটির সদস্যরা চিনিকলেই অবস্থান করছিলেন।

তদন্ত কমিটির প্রধান আকুল হোসেন বলেন, ‘আমাদের তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। প্রয়োজন হলে আরও সময় নেব। সঠিক বিষয়টা আমরা তুলে আনতে চাই। তারপর আমরা করপোরেশনে প্রতিবেদন দেব। সে অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।’