বরিশাল সিটি নির্বাচন 

এক দশক পরও ‘ভোটের মাঠে’ হিরন

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

আর মাত্র ১৩ দিন পর বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। চায়ের দোকান থেকে অভিজাত পাড়া, বর্ধিত এলাকা থেকে নগরভবন, সর্বত্র আলোচনার ঝড় বইছে কে হচ্ছেন নতুন নগরপিতা? প্রার্থীরা যেমন ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন তেমনি প্রার্থী বাছাইয়ে হিসাব মিলাচ্ছেন ভোটাররা।

এরই মাঝে ভোটার আর প্রার্থীর আলোচনায় উঠে আসছে এক দশক আগের মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরনের নাম। অনেক প্রার্থী হিরনের শূন‌্যতা পূরণ করার আশ্বাস নিয়ে যাচ্ছেন ভোটারদের দুয়ারে, আবার ভোটাররা চেষ্টা করছেন কে প্রয়াত এই মেয়রের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন তার ধারণা নিতে।

ফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদল, ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতার প্রার্থিতার আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে এখন নগরীতে চলছে শওকত হোসেন হিরনের বন্দনা।

২৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার মাসুদ রানা বলেন, ভ্যাট-ট্যাক্স সবই আমরা কর্পোরেশনকে দিই। অথচ হিরন সাহেব মারা যাওয়ার পর আমাদের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন হয়নি। আহসান হাবিব কামাল, তারপর সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ কেউ জনগণের খোঁজ নেয়নি। উল্টো আমরা ভবন ভাঙার আতঙ্কে থাকতাম।

১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাকসুদা খানম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা চরমোনাই হুজুরের দল বুঝি না। আমরা চাই হিরন মিয়ার (শওকত হোসন হিরন) মতো যে জনগণকে ভালোবাসবে তাকে নির্বাচিত করতে। যে বলতে পারবে আমি হিরন হব, জনগণ তাকে ভোট দিবে।’

লঞ্চঘাট এলাকায় কথা হয় এক রিকশাচালকের সঙ্গে। ভোলায় তার বাড়ি। তিনি  বলেন, ‘২৫ বছরের বেশি সময় ধরে বরিশালে থাকি। মেয়র-কমিশনার অনেক দেখছি। হিরন সাহেবের মতো মেয়র আমি ভোলা-বরিশালের কোথাও দেখিনি। আমি চাই বরিশালে হিরন সাহেবের মতো কেউ নির্বাচিত হোক।

তিনি আরও বলেন, ‘শহরে আমার ভোট না থাকলেও বড় আশা করছিলাম সাদিক মিয়া (সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ) মেয়র হয়ে শহরটাকে সিঙ্গাপুর বানাবে। সে তো প্রধানমন্ত্রীর ভাইপো। কিন্তু ঘটলো উল্টা, মানুষ মরা ধরছিল। সে মনোনয়ন পায় নাই, এজন‌্য আমরা সবাই খুশি। এখন চাই আরেকজন হিরন আসুক।’

শুধু ভোটার নয় শওকত হোসেন হিরনের কথা বলে বা তার সময়ের প্রশংসা করে ভোট চাইছেন প্রার্থীরাও।

রোববার (২৮ মে) বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে একটি নির্বাচনী সভায় আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ সর্বশেষ মেয়রের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, নগরবাসীর সঙ্গে সবচেয়ে বড় জুলুম করা হয়েছে অতিরিক্ত ট্যাক্স ধার্য করে। আমি নির্বাচিত হলে হোল্ডিং ট্যাক্স সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে।

তিনি আরও বলেন, শওকত হোসেন হিরনের মৃত‌্যুর পর গত দশ বছরে বরিশালের কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরিশালের মানুষ সম্মান পায়নি। নির্বাচিত হলে তাদের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে সমৃদ্ধশালী মহানগরী গড়তে সুপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ করা হবে। আমি নির্বাচিত হলে নাগরিকরা ২৪ ঘণ্টা সেবা পাবেন। আমি শতভাগ চেষ্টা করবো নগরবাসীর জন্য একটি উন্নত, আধুনিক ও সমৃদ্ধশালী বরিশাল নগর গড়তে।

একই দিন সন্ধ‌্যায় বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মিট দ‌্যা প্রেস অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টি মনোনীত লাঙল প্রতীকের মেয়র প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, শওকত হোসেন হিরন না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার পর বরিশাল নগরী থমকে গেছে। কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। মানুষ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যদি আমি নির্বাচিত হতে পারি তাহলে হিরনের শূন্যস্থান পূরণ করা হবে।

তাপস তাকে সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নগরীকে ব‌্যবসা ও উদ্যোক্তাবান্ধব করে গড়ে তোলা হবে। আইসিটি স্থাপন করা হবে। শহরের পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে পর্যটনভিত্তিক স্থাপনা নির্মাণ করে দৃষ্টিনন্দন শহরে রূপান্তরিত করা হবে, যেই কাজ শুরু করে গিয়েছিলেন শওকত হোসেন হিরন।

যে কারণে আলোচনায় হিরন

নির্বাচন বিশ্লেষক ও বরিশাল বিশ্ববিদ‌্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম‌্যান সোহেল রানা মনে করেন, প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরন তার মেয়াদকালে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অনন্য দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। দিনশেষে সাধারণ মানুষ প্রশাসকের আন্তরিকতার মাত্রা দেখে তার মূল‌্যায়ন করেন। এই মূল্যায়ন মেয়াদকালেও হতে পারে, পরবর্তীতেও হতে পারে। এখানে আন্তরিকতাই অন্যতম মূল ইনডেক্স বলে আমার ধারণা।

তিনি আরও বলেন, মেয়র হিরন বরিশাল নগরীর প্রায় প্রত্যেকটি জায়গা ধরে ধরে উন্নয়ন প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। প্রাপ্ত উন্নয়ন বাজেট এবং তার যথাযথ ব্যবহার করতে পারলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। সেটি তার ক্ষেত্রে ঘটেছে। অর্থাৎ, প্রয়োজনীয় বাজেট, জনপ্রতিনিধির উন্নয়ন-আন্তরিকতা ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, এই তিনটি বিষয়ের যোগসূত্র ভালোভাবে সেসময় সমন্বয় ঘটেছে। ফলে, তিনি কেবল বরিশালবাসীর নিকটই নন, সারা দেশেই একজন আইকনিক সিটি মেয়র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। এসব কারণে দেখা যাচ্ছে, বিসিসির নির্বাচনের প্রশ্নটি সামনে এলেই প্রয়াত মেয়র হিরনের নামটিও তার সঙ্গে বারবার যুক্ত হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন শওকত হোসেন হিরন। ওই পাঁচ বছরে পরিকল্পিত উন্নয়ন শুরু করে প্রশংসিত হন তিনি। তবে ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৭ হাজার ১০ ভোটে পরাজিত হন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আহসান হাবিব কামালের কাছে। পরাজিত হয়ে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে পরাজয়ের নেপথ্যের কারিগর হিসেবে দোষারোপ করেন। আর ২০১৪ সালের ৯ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান সাবেক সফল এই জনপ্রতিনিধি।