মানুষের জীবনকে ওষুধ কোম্পানির মুনাফার উপরে স্থান দিতে হবে: ড. ইউনূস

মানুষের ইতিহাস মূলত সম্মিলিত স্বার্থে পরিচালিত হবার ইতিহাস, ব্যক্তি স্বার্থে নয়। অর্থনীতিবিদরা আমাদেরকে এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছেন যে, আমরা কেবল ব্যক্তিস্বার্থেই পরিচালিত হই, আর এজন্য ব্যক্তিগত মুনাফা সর্বোচ্চ করতে কাজ করি। এখন সময় হয়েছে ব্যবসাকে পুরোপুরি সমাজের চাহিদা পূরণের কাজে নিয়োজিত করে সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে আমাদের মূল পরিচয়কে পুনরুদ্ধার করা; মুনাফা কখনোই মানুষের মঙ্গল ও জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হতে পারে না। এটা আরও বেশি সত্য আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে- যাকে ১৯৪৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংবিধানে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। আমি তখন মাত্র ৬ বছরের শিশু।

এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, ঔষধ শিল্প- যা কোভিড-১৯ এর এই সময়ে নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরির জন্য সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে- করদাতাদের অর্থে অর্জিত উদ্ভাবনের ফসল নিয়ে গোপন একচেটিয়া চুক্তি করেছে, যেখানে কি-না তাদের উচিত ছিল এই ভ্যাকসিনের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বত্বাধিকার ও প্রযুক্তি মানবতার পরবর্তী মহৎ কর্মে স্বেচ্ছায় হস্তান্তর করে দেওয়া। এই ভ্যাকসিনকে পৃথিবীর সকল জায়গায়, সকলের কাছে সম্ভাব্য সবচেয়ে কম খরচ ও সময়ে পৌঁছে দেওয়া।

এখানে ভুল বুঝাবুঝির কোনও সুযোগ নেই। আমরা যদি একযোগে, সম্মিলিতভাবে এই কাজ করতে ব্যর্থ হই তাহলে এর ফলাফল হবে ভয়ানক ও দীর্ঘস্থায়ী। এরই মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার ধনী দেশগুলো এই ভ্যাকসিনের বৈশ্বিক সরবরাহের প্রায় সবটাই তাদের জনগণের স্বার্থে তাদের নিজেদের দখলে নিয়ে গেছে এবং এর ফলে নিম্ন আয়ের দেশগুলো ভ্যাকসিন পাবার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। আমরা যখন ২০২১ সালের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত, তখন এই মহামারীর একটি ভ্যাকসিন-চালিত পরিসমাপ্তির সম্ভাবনার পরিবর্তে বরং এক বিরাট নতুন সামাজিক বিভাজন দক্ষিণ গোলার্ধের অনেকের মধ্যেই ভীতি ও ক্রোধের সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, যাদের ভ্যাকসিন আছে ও যাদের নেই- এই বিভাজন।

 

এই মহামারী যত বিস্তৃত হবে তত বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করতে থাকবে এবং এই ভাইরাসও তত বেশি পরিবৃত্তির ও ভ্যাকসিন-প্রতিরোধী হবার সুযোগ পাবে। এর ফল হবে সর্বত্র ভাইরাসটির নতুন নতুন প্রবাহের ঝুঁকি।

অপরদিকে কোভ্যাক্স (COVAX) এর মতো প্রশংসনীয় বর্তমান পদ্ধতি সত্ত্বেও ২০২১ সালের শেষে পৃথিবীর সর্বত্র এই ভ্যাকসিনের পর্যাপ্ত ডোজ নিশ্চিত করা যাবে না। উত্তর গোলার্ধ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. টেড্রোস এর এই জরুরি সতর্কবার্তা শুনতেই চাচ্ছে না যে, “সকলকে নিরাপদ না করা পর্যন্ত কেউই নিরাপদ নয়।” আগামী দীর্ঘ একটি বছরে সকল দেশকে জরুরিভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সামগ্রীসমূহ সংগ্রহ করতে হবে, সর্বনিম্ন খরচে সকলের জন্য কার্যকর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে এবং সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণদের- যেমন স্বাস্থ্যকর্মী ও বয়স্ক মানুষদেরকে যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন দিতে হবে।

আর এ কারণে প্রায় ১০০টি দেশ সকল কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ও এর চিকিৎসা প্রযুক্তির প্যাটেন্ট ও বুদ্ধিবৃত্তিক মালিকানার ওপর একটি ব্যাপক-ভিত্তিক সাধারণ স্বত্বত্যাগ জারি করতে এ মাসে WTO-তে একটি প্রস্তাবে সমর্থন দিচ্ছে। এই প্রস্তাবের নেতৃস্থানীয় কো-স্পন্সর দক্ষিণ আফ্রিকা, যেখানে HIV/AIDS মহামারীতে এরই মধ্যে বিপুল মানুষের নিরর্থক প্রাণহানির মর্মান্তিক ইতিহাস রয়েছে।

এই ভ্যাকসিনকে প্যাটেন্ট-মুক্ত করার সাধারণ একটি ঘোষণার মধ্য দিয়েই পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি সম্ভব। কিন্তু দুঃখজনক যে, মানুষের জীবন রক্ষার- বিশেষ করে জনবহুল দেশগুলোতে- এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পৃথিবীতে বরং একটি উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো ধনী দেশগুলো এখনও এই রেজ্যুলেশনের বিরুদ্ধাচরণ করে আসছে- যে রেজ্যুলেশন স্বল্প আয়ের দেশগুলো কর্তৃক তাদের নিজেদের জনগণের জন্য স্বল্পতম খরচে, বুদ্ধিবৃত্তিক অধিকারস্বত্ব ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত হবার ভয়ে ভীত না হয়ে, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা প্রযুক্তি পাবার সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। এটা সম্ভবত আরও দুঃখজনক যে, ব্রাজিল তার দীর্ঘদিনের অবস্থান থেকে সরে এসে সেসব দেশের সাথে হাত মিলিয়েছে যারা এই ভ্যাকসিনের প্যাটেন্ট-মুক্ত উৎপাদনের বিরোধিতা করে আসছে।

বিশ্ব নেতাদের এখন সময় এসেছে এটা প্রমাণ করা যে, কাউকে পেছনে ফেলে না রাখতে “চেষ্টার কোনও ত্রুটি না করার” তাদের যে ঘোষণা তার প্রতি তারা আসলেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের এখন বিশ্ববাসীকে দেখাতে হবে যে, তাদের কথার চেয়ে কাজের জোর বেশি।

চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের নেতৃত্বে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আসন্ন সম্মেলনের পূর্বে ইউরোপের সরকার প্রধানদের এখনই ঠিক করতে হবে, তারা তাদের ওষুধ কোম্পানিগুলোর স্বার্থের দিকে চেয়ে তাদের দৃষ্টি নিজ নিজ দেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রাখবেন, নাকি ভ্যাকসিন পুঁজিবাদকে পরিত্যাগ করে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোর সাথে সংহতি প্রকাশ করবেন। ইউরোপ যদি দক্ষিণ গোলার্ধের সাথে মিলিত হয়ে মানুষকে প্যাটেন্টের উপরে স্থান দেয় ও অধিকারস্বত্ব ত্যাগে দেশগুলোকে সহায়তা করে, তাহলে WTO -তে উত্থাপিত রেজ্যুলেশন অনায়াসে তিন-চতুর্থাংশ ভোটে পাশ হয়ে যাবে।

পরিবেশ সংকট এরই মধ্যে পৃথিবীতে মানবজাতিকে সবচেয়ে বিপন্ন প্রজাতিতে পরিণত করেছে। এখন মহামারী দক্ষিণ গোলার্ধকে ভ্যাকসিনবিহীন এবং আরও খারাপ ও নকল ভ্যাকসিনে সয়লাব করে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে ধাবিত করতে যাচ্ছে। এই ভ্যাকসিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৃদ্ধিবৃত্তিক অধিকারস্বত্ব বাতিলের একটি সরল সিদ্ধান্ত বিপুল সংখ্যক মানুষকে রক্ষা করতে পারে- যেমনটি পোলিও ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ঘটেছিল।

পৃথিবীর সকল প্রান্তে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে ও খরচে একটি নিরাপদ ও কার্যকর কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন পৌঁছে দিয়ে আমরা মানবজাতি পৃথিবীর বুকে একত্রে টিকে থাকার সক্ষমতায় আমাদের পুনর্জীবিত আস্থার মধ্য দিয়ে একটি নতুন যুগের ভিত্তি রচনা করতে পারি এবং আমাদের এই বিশ্বাসকে দৃঢ়তর করতে পারি যে, আমরা মানবকুল পৃথিবীর “সবচেয়ে বিপন্ন প্রজাতি” থেকে আমাদের অবস্থানকে “উদ্ধারকারী প্রজাতি”তে পরিবর্তিত করতে সক্ষম। আশা করছি ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ এই ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া করবেন না।

প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনকে একটি “সর্বসাধারণের সামগ্রী” ঘোষণার লক্ষ্যে একটি বৈশ্বিক প্রচারণা শুরু করেছেন যেখানে তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ২৪ জন নোবেল লরিয়েট এবং আরও শতাধিক খ্যাতনামা বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা প্রযুক্তিগুলো পৃথিবীর সর্বত্র সহজলভ্য করার জন্য এগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক মালিকানা ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন বাধা-নিষেধ দূর করতে তার এই আহ্বানে এ পর্যন্ত পৃথিবীর ১০ লাখেরও বেশি মানুষ যোগ দিয়েছেন।

অনুবাদ: কাজী নজরুল হক

 

সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন