মহান আল্লাহ যেভাবে কোরআন শেখা সহজ করেছেন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ 

কোরআন শেখা ও হিফজ করার ব্যাপারে সাধারণ ধারায় শিক্ষিতদের ভেতর এক ধরনের ভীতি কাজ করে। তারা মনে করে, কোরআন শেখা ও মুখস্থ করা কঠিন। এই ভয়ের কারণে অনেকেই কোরআন শেখা থেকে দূরে থাকে, আবার কেউ কেউ শুরু করার পরও দূরে সরে যায়। কিন্তু কোরআন শেখা কি আসলেই কঠিন? পবিত্র কোরআনের ভাষ্য অনুসারে এমন দাবি অমূলক; বরং আল্লাহ কোরআনকে সহজ করেছেন।

কোরআন শেখা সহজ : মহান আল্লাহ মানুষের জন্য কোরআন শেখা সহজ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘কোরআন আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য; অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?’ (সুরা কামার, আয়াত : ১৭)

ইমাম কুরতুবি (রহ.) আয়াতের অর্থ এভাবে করেছেন—‘আমি তা সহজ করেছি মুখস্থের জন্য, যে মুখস্থ করতে চায় তাকে সাহায্য করি। সুতরাং তা মুখস্থ করতে আগ্রহী কেউ আছে কী? যাকে সাহায্য করা হবে। ’ (তাফসিরে কুরতুবি : ১৭/১৩৪)

‘উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?’ বাক্যের ব্যাখ্যায় ইমাম সুয়ুতি (রহ.) লেখেন, তা দ্বারা উপদেশ গ্রহণকারী ও তা মুখস্থকারী কেউ আছে কি? এখানে প্রশ্নবোধক বাক্য দ্বারা আদেশ বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তোমরা তা মুখস্থ করো এবং তা দ্বারা উপদেশ গ্রহণ করো। (তাফসিরে জালালাইন, পৃষ্ঠা ৭০৬)

সহজ হওয়ার ঘোষণা চারবার : কোরআন শেখা, মুখস্থ ও আত্মস্থ করার বিষয়টি সহজ—তা বান্দার অন্তরের গভীরে প্রোথিত করতে এবং এই বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করতে ‘আমি কোরআন সহজ করে দিয়েছি’ ঘোষণাটি একই সুরায় চারবার এনেছেন। সুরা কামারের ১৭, ২২, ৩২ ও ৪০ নম্বর আয়াতে বাক্যটির পুনরাবৃত্তি হয়েছে।

সহজ হওয়া কোরআনের অলৌকিকত্ব : অবতীর্ণ হওয়ার সময় থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি চর্চিত ধর্মগ্রন্থ কোরআনুল কারিম। পৃথিবীর আর কোনো ধর্মগ্রন্থ এত বিপুলসংখ্যক মানুষ সর্বযুগে এভাবে মুখস্থ করেনি। নির্ভুলভাবে কোরআন মুখস্থের ক্ষেত্রে আরব ও অনারবের ভেতর পার্থক্য দেখা যায় না। বহু অনারব এমন আছে, যারা কোরআনের অর্থ জানে না; কিন্তু নির্ভুলভাবে তা মুখস্থ করেছে। এ জন্য ইমাম আবুল হাসান মাওয়ার্দি (রহ.) বলেন, ‘কোরআনের একটি অলৌকিকত্ব হলো, তা সব ভাষাভাষী মানুষের জন্য সহজ। এমনকি তা মুখস্থ করতে পারেন আরবি ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ অনারবরাও। অন্য কোনো কিতাব কোরআনের মতো মুখস্থ করা যায় না। এটা এক অলৌকিক বৈশিষ্ট্য, যার মাধ্যমে আল্লাহ কোরআনকে সব ধর্মগ্রন্থের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। ’ (আ’লামুন নুবুওয়াহ, পৃষ্ঠা ৬৯)

আল্লামা ইবনুল জাঝারি (রহ.) বলেন, ‘কোরআন বর্ণনার ক্ষেত্রে মূলত অন্তরের সংরক্ষণের ওপর নির্ভর করা হয়, পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থের ওপর নির্ভর করা হয় না। এটা এই উম্মতের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য। ’ (আন-নাশরু ফি কিরায়াতিল আশার : ১/৬)

কোরআন শিক্ষায় মুসলিম ঐতিহ্য : মুসলিম সমাজ ও সভ্যতার ঐতিহ্য হলো শিশুরা কোরআনের পাঠ গ্রহণের মাধ্যমে তাদের শিক্ষাজীবন শুরু করবে। কোরআন না শেখা পর্যন্ত অন্যান্য ইসলামী জ্ঞানের পাঠ তাদের দেওয়া হতো না। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘পূর্বসূরি আলেমরা কোরআন মুখস্থ না করা পর্যন্ত কাউকে হাদিস ও ফিকহ শেখাতেন না। ’ (আল-মাজমু : /৩৮)

কোরআন সব জ্ঞানের আকর : কোরআন ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূলভিত্তি। তাই কোরআন শিখলে অন্যসব জ্ঞান অর্জন করা সহজ হয়ে যায়। ইবনু জামাআহ (রহ.) বলেন, ‘জ্ঞানান্বেষী ব্যক্তির প্রথম শিষ্টাচার হলো সে মহান আল্লাহর শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাজীবনের সূচনা করবে, মুখস্থ করার মাধ্যমে তাতে দৃঢ়তা অর্জন করবে এবং তাঁর ব্যাখ্যাসহ সমস্ত জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট হবে। কেননা তা জ্ঞানের মূল, তার মা এবং পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান। ’ (আদাবুল আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃষ্ঠা ১৬৬)

কোরআন মুখস্থকরণে উৎসাহ দান : রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরআন শেখা ও তা মুখস্থ করাকে নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। যেমন সাহাবিদের মধ্যে কার কতটুকু কোরআন মুখস্থ তার ভিত্তিতে তিনি তাদের মর্যাদা নির্ণয় করতেন এবং অধিক মুখস্থকারীকে নেতৃত্ব দিতেন, কোথাও কাফেলা প্রেরণের সময় অধিক কোরআন মুখস্থকারীকে তিনি দলপ্রধান ও নামাজের ইমাম নিযুক্ত করতেন, কবরে রাখার ক্ষেত্রে কোরআনের হাফেজকে অগ্রাধিকার দিতেন এবং কখনো কখনো ব্যক্তির মুখস্থ থাকা কোরআনের বিনিময়ে তাকে বিয়ে দিয়েছেন। (ওয়া রাততিলিল কোরআনা তারতিলা, পৃষ্ঠা ৬৯)

কোরআন মুখস্থ রাখাও সহজ : কোরআন ভুলে যাওয়ার ভয়ে অনেকে কোরআন মুখস্থ করেন না। কিন্তু আল্লাহ কোরআন আত্মস্থ করা যেমন সহজ করেছেন, তেমন তা মুখস্থ রাখাও সহজ করেছেন। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, ‘আমি তোমাকে পরীক্ষা করার উদ্দেশে এবং তোমার দ্বারা অন্যদের পরীক্ষা করার উদ্দেশে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছি। আর তোমার প্রতি আমি এমন কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যা পানি কখনো ধুয়ে-মুছে ফেলতে পারবে না। ঘুমন্ত ও জাগ্রত অবস্থায় তুমি সেটা পাঠ করবে। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৭০৯৯)

হাদিস বিশারদরা বলেন, উল্লিখিত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, আল্লাহ মুমিনের অন্তরে কোরআন সংরক্ষণ করবেন। কালের আবর্তনে তা হারিয়ে যাবে না। নিম্নোক্ত আয়াতেও যার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘বরং যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে বস্তুত তাদের অন্তরে এটা স্পষ্ট নিদর্শন। শুধু অবিশ্বাসীরাই আমার নিদর্শন অস্বীকার করে। ’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত : ৪৯)

নবীজি (সা.)-এর হুঁশিয়ারি : আল্লাহ কোরআন শেখা, মুখস্থ করা ও রাখা সহজ করেছেন। তাই বলে কোরআনের প্রতি অমনোযোগী হওয়া যাবে না। যারা কোরআনের দৌলত পেয়েও তা অবহেলা ও অযত্ন করে আল্লাহ তাদের থেকে তা ছিনিয়ে নেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা কোরআনের প্রতি লক্ষ রাখবে। যে পবিত্র সত্তার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ! কোরআন বাঁধন ছাড়া উটের চেয়েও দ্রুতগতিতে দৌড়ে যায়। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০৩৩)

আল্লাহ সবাইকে কোরআন শেখার তাওফিক দিন। আমিন।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ