‘মহাদেবপুরে ভূয়া প্রকল্প দেখিয়ে কাবিখা-কাবিটার প্রকল্পের অর্থ সভাপতিদের পকেটে!

মহাদেবপুর প্রতিনিধি :
নরেশ পাল (৬০)। গত পাঁচযুগ থেকে বসবাস করছেন নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার নাটশাল গ্রামে। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্পের আওতায় তাদের গ্রামে বাস্তবায়িত “নাটশাল বটতলীর পাকা রাস্তা হতে আনোয়ারের মিল পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার” প্রকল্পের বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি। জানতে চাইলে তিনি জানান, গত ১৫ বছর আগে একবার এই সড়কে মাটি কাটার কাজ হয়েছে। এরপর আর সংস্কার তো দূরের কথা; এক কোঁদাল মাটি পর্যন্ত খোঁড়া হয়নি।

শুধু নরেশ পাল নয়, এমন কোনোই প্রকল্পের কাজ হতে দেখেননি বলে নিশ্চিত করেছেন নাটশাল গ্রামের মকলেছার, খলিল, আজিজুল ইসলাম, শহিদুল ইসলামসহ অনেকেই। এ ছাড়াও একই অর্থ বছরে কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) প্রকল্পের অধীনে বাস্তবায়নকৃত “মহাদেবপুর কলেজ রোড পাইকড়ের গাছ হতে ব্র্যাক অফিস হয়ে নজরুল বাবুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার” কাজের কোনোই অস্তিত্ব মেলেনি। ওই এলাকার মনি মালা, আব্দুল জব্বার, অনিতাসহ ১০-১২ জন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, গত কয়েক বছর থেকে রাস্তাটি সংস্কার করা হয়নি। এটি এখন চলাচলের অযোগ্য। সরেজমিন গিয়ে ওই দুটি প্রকল্পের ব্যাপারে স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্যের সত্যতা মিলেছে।

এসব প্রকল্পের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু গত জুনে কাগজে-কলমে প্রকল্প দুটি শতভাগ সম্পন্ন বলে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে- কাজ না করেই নামসর্বস্ব শ্রমিকের তালিকা তৈরি করে ভূয়া মাস্টাররোলের মাধ্যমে বরাদ্দের অর্থ ও খাদ্যশস্য পরিশোধ করেছে সংশ্লিষ্টরা। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রকাশ্যে দুর্নীতি করতে অস্তিত্বহীন প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাত করেছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এটিকে দুর্নীতির বহুল প্রচলিত কৌশল হিসেবেই দেখছেন স্থানীয়রা। জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে অনেকেই বলছেন, কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। এনিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আর সুশাসন বিশ্লেষকদের মতে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে আরও কঠোর হতে হবে। দুর্নীতিবাজদের লাগাম টেনে ধরতে দেশের প্রচলিত আইনে বিচার করে শাস্তি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। সরকারি প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

সম্প্রতি তথ্য অধিকার আইনে আবেদনের প্রেক্ষিতে মহাদেবপুর সদর ইউপি কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের আওতায় উপজেলার নাটশাল গ্রামে “নাটশাল বটতলীর পাকা রাস্তা হতে আনোয়ারের মিল পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার” ও উপজেলা সদরের কলেজ পাড়া এলাকায় “মহাদেবপুর কলেজ রোড পাইকড়ের গাছ হতে ব্র্যাক অফিস হয়ে নজরুল বাবুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার” নামে পৃথক দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর একটিতে পাঁচ মেট্রিক টন চাল ও অপরটিতে চার লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মহাদেবপুর সদর ইউপি সদস্য শিহাব রায়হান ও জান্নাতুল ফেরদৌসী। কাগজে-কলমে শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য ও অর্থ উত্তোলন করেছে পিআইসি’র সভাপতি ও সম্পাদক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দরিদ্র জনগনের আয় বৃদ্ধি, দেশের সর্বত্র খাদ্য সরবরাহের ভারসাম্য আণয়ন ও দারিদ্র বিমোচনে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। নিয়ম অনুযায়ি বরাদ্দের খাদ্যশস্য ও অর্থ প্রকল্পের সুবিধাভোগী শ্রমিকের পাওয়ার কথা। শুধুমাত্র কাগজে-কলমে ওই প্রকল্পদুটি বাস্তবায়ন হওয়ায় এলাকার দরিদ্র শ্রমিকরা সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

কাজ না করেই বরাদ্দের অর্থ ও খাদ্যশস্য আত্মসাতের বিষয়ে মুঠোফোনে বক্তব্য দিতে রাজি হননি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও মহাদেবপুর সদর ইউপি সদস্য শিহাব রায়হান। প্রতিবেদককে তিনি সামনাসামনি দেখা করতে বলেন। প্রকল্পের বিষয়ে তেমন কিছুই জানাতে পারেননি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মুলতান হোসেন। তিনি বলেন, দেখতে হবে প্রকল্পের কী অবস্থা। তার যোগসাজশে অস্তিত্বহীন ওই দুটি প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি অর্থ ও খাদ্যশস্য আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কৌশলে এড়িয়ে যান এই সরকারি কর্মকর্তা। এ ব্যাপারে মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুল হাসান সোহাগের বক্তব্য জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে প্রতিবেদককে অফিসে দেখা করতে বলেন তিনি।

উল্লেখ্য, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে টিআর প্রকল্পের আওতায় ‘মহাদেবপুর ইউপি কার্যালয় চত্বরে সেবাপ্রার্থীর জন্য বসার স্থান নির্মাণ’ নামে একটি অস্তিত্বহীন প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে গত অক্টোবর মাসে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে তোলপাড় শুরু হয়। এলাকায় ছি: ছি: রব উঠে। বিষয়টি টক অফ দ্য টাউনে পরিণত হলে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সরেজমিন তদন্ত করেন নওগাঁর স্থানীয় সরকার উপপরিচালক। এরপর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে বদলির আদেশ দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অথচ এ পর্যন্ত তিনি মহাদেবপুরেই কর্মরত আছেন।