জমির শোকে কৃষকের মৃত্যু

মহাদেবপুরে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে কৃষিজমি, মিলছে না প্রতিকার!


মহাদেবপুর প্রতিনিধি :

কৃষক আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা। বয়স ৬৫ বছর। বাড়ি নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চাঁন্দাশ ইউপি’র তংকাশিবপুর গ্রামে। বালু খেকোদের তাণ্ডবে তাদের কয়েক বিঘা জমি নর্দীগর্ভে বিলীন হয়েছে। অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে বছরের পর বছর ধরনা দিয়েও কোনোই প্রতিকার মেলেনি। জমি হারানোর শোকে সম্প্রতি স্টোক করে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। শুধু আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা নয়, ওই গ্রামের অনেক কৃষকই জমি হারিয়েছেন। উপজেলার বুক চিরে প্রবাহিত আত্রাই নদীতে অবৈধ খননযন্ত্র (ড্রেজার) বসিয়ে নদীর তলদেশে গভীর করে অবাধে বালু তোলা হচ্ছে।

এতে ফসলি জমি নদীতে ধ্বসে পরছে। ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রতিনিয়ত নর্দীগর্ভে বিলীন হচ্ছে কৃষকের সম্বল। বসত-বাড়িতে ফাঁটল ধরেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা চরম আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। বালুদস্যুরা কৃষকদের ভবিষ্যতকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু এনিয়ে জেলা বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা কমিটির দৃশ্যমান কোনোই তৎপরতা নেই। তাদের রহস্যজনক নীরব ভূমিকা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে- সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চলছে অবৈধ খননযন্ত্র দিয়ে বেআইনি বালু উত্তোলন।

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০-এর ধারা ৫-এর ১ উপধারা অনুযায়ী, পাম্প, খননযন্ত্র (ড্রেজিং) বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ধারা ৪ এর (খ) অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেল লাইন ও অনান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা হতে সর্বনিম্ন ১ কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এ নদী থেকে বালু তোলার ক্ষেত্রে আইন মানা হচ্ছে না। বালু উত্তোলন বন্ধে এলাকাবাসী প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়েও তেমন কোনো প্রতিকার পায়নি।

বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১১টায় আত্রাই নদীতে অবাধে বালু উত্তোলন করে বসতবাড়ি, বাঁধসহ আবাদি জমি বিনষ্ট করায় বালু উত্তোলন বন্ধসহ ক্ষতিপূরণের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন চাঁন্দাশ ইউনিয়নের জনসাধারণ। এতে চাঁন্দাশ ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদান নবী রিপন, ৩-৪ জন ইউপি সদস্যসহ এলাকার কয়েক’শ মানুষ অংশগ্রহণ করেন। মানববন্ধন শেষে তারা জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি), ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে আবারও লিখিত অভিযোগ প্রেরণ করেন।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, উপজেলা সদরের মেসার্স হ্যাপি ট্রেডার্স এর মালিক মোয়াজ্জেম হোসেন গত জানুয়ারি থেকে সমুদ্র ড্রেজিং এর কাজে ব্যবহৃত খননযন্ত্র বসিয়ে বালু উত্তোলন করছে। ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফসলি জমি নদীতে ধ্বসে পরছে। এতে তংকাশিবপুর গ্রামের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক মোল্লাসহ গ্রামের কৃষকদের ৮-১০ বিঘা জমি নদীতে ধ্বসে পরে। প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে বছরের পর বছর ঘুরেও প্রতিকার না পেয়ে জমি হারানোর শোকে স্টোক করে মারা যান তিনি। অবৈধ খননযন্ত্র বসিয়ে নদীর তীর ঘেঁসে বালু উত্তোলনের প্রতিবাদ করলে স্থানীয়দের মামলা-হামলাসহ নানা ভয়-ভীতি দেখায় বালু ব্যবসায়ী মোয়াজ্জেম ও তার সহযোগীরা। অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান বক্তারা।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ড্রামের সাহায্যে খননযন্ত্র ভাসিয়ে রেখে আত্রাই নদীর শ্রীমন্ত ঘাট এলাকা থেকে অবৈধ খননযন্ত্র (ড্রেজার) দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। যন্ত্রের মাধ্যমে দিন-রাত নদীর ১২০-১৩০ ফুট গভীর করে চলছে বালুৃ উত্তোলন। প্রতিদিন কয়েক শত ট্রাক বালু বিক্রি করে বিশেষ একটি প্রভাবশালী মহল হাতিয়ে নিচ্ছে কয়েক লাখ টাকা। গ্রামবাসী জানায়, বালু লুটপাটের মহোৎসবে নদী পাড়ের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হলেও সংশ্লিষ্টরা রহস্যজনক কারণে নীরব। খননযন্ত্র বসিয়ে যেভাবে বালু তোলা হচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে তাদের গ্রাম বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বালু উত্তোলনে গ্রামবাসী বাধা দিলে নানাভাবে তাদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। সংশ্লিষ্টদের সঠিক তদারকি না থাকায় খননযন্ত্র দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তারা অত্যান্ত প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে এলাকার কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না। ফলে বালু উত্তোলনকারীরা বেপরোয়া। অবৈধ খননযন্ত্র বসিয়ে বালু উত্তোলনের কথা স্বীকার করেছেন মেসার্স হ্যাপী ট্রেডার্স এর মালিক মোয়াজ্জেম হোসেন। জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু হাসান জানান, ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন। প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তিনি।