মফস্বল কলেজে উচ্চ শিক্ষা: মান ও বাস্তবতা

মফস্বল বলতে আমি শহর থেকে দূরবর্তী স্থান বা গ্রাম এলাকা বুঝিয়েছে। যে এলাকায় আধুণিক প্রযুক্তি ও উন্নয়ন উপাদান সরবারাহ অপ্রতুল। এসব এলাকায় যোগাযোগ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে নি। জীবনমান নিন্ম হওয়ায় দেশে-বিদেশে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আসা কোন গবেষক, লেখক এসব এলাকায় বসবাস করতে চান না। একারণে এসব এলাকায় রয়েছে ‘রিসোর্স পারসনের’ অভাব। তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অনুপ্রবেশ রয়েছে সীমিত পরিসরে।

 

মফস্বলে উচ্চ শিক্ষার অন্যতম প্রধান অন্তরায় হলো, এখানে কৃষি ও শ্রমনির্ভর উপার্জনের ব্যাপকতার পরিবেশ বিরাজ করবার কারণে মানুষে-মানুষের মধ্যে উদ্ভাবনী চিন্তার প্রতিযোগিতা নেই। সেজন্য মানুষের মধ্যে সুকুমারবৃত্তির বিকাশ হওয়ার সম্ভবনা কম থাকে। এসব এলাকার শিক্ষকদের বাড়ি কলেজের আশে পাশে হওয়ায় তাঁরা নিজেদের ‘লোকাল ম্যান’ মনে করে। নিজেদের কাজকর্ম ছাড়া কিং মনে করেন। এসকল হীনচিন্তার কারণ হেতু, একেক জনের ক্ষমতার দাপটের কাছে সরকারী তদারকী প্রতিষ্ঠান অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়ে। তাই শিক্ষকদের কাজের তদারকীকরণে তেমন কোন শক্ত ভিত তৈরী করা যায় না। বেতনভুক্ত অনেক শিক্ষকদের ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, (মান্থলী পে অর্ডার বা এমপিও) তাদের চাকুরি যেন “শিক্ষার্থী পাশ করানোর বিনিময়ে বেতন”। এই বিশ্বাসে অনেক শিক্ষক নিজেদের শিক্ষার্থীদের পাশ করানোর জন্য পরীক্ষা কক্ষে নানা কায়দায় নকল সরবারহ করে থাকেন। নকল সরবরাহকে অনেকে ক্ষমতা, দাপট ও সম্মানের কাজ মনে করেন। আবার অনেক শিক্ষক নিজেদর প্রাইভেট-টিউশনি জনপ্রিয় করে তুলতে প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে নকল তুলে দিয়ে ভালো রেজাল্ট করতে উঠেপড়ে লেগে থাকেন। সার্বিক ভাবে বলতে গেলে, উচ্চশিক্ষার মান ও উপকরণ সরবরাহ এ দুই ক্ষেত্রে মফস্বলের কলেজ অনেক পিছিয়ে।

 
এতোকিছুর পরও ইদানিং বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে মফস্বলে অবস্থিত কলেজসমূহে অনার্স কোর্স চালুর হিড়িক পড়ে গেছে। নামকরণ চলছে ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ নামে। কী এর যৌক্তিকতা তা আমার বোধগম্য নয়। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে এসব কলেজে উচ্চ শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হওয়া দরকার। তারপরও বিষয়টি আমি এভাবে বলার কারণ হলো, যেসমস্ত কলেজে অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে তাদের অনেক শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষা দেওয়ার যে যোগ্যতা দরকার তা নেই। যোগ্যতা বিনিমার্ণের কোন প্রচেষ্টাও নেই। অথচ কলেজ কর্তৃপক্ষ নিত্যদিন ‘তৃতীয়/চতুর্থ শিক্ষক’ নামক পোষ্ট খুলে দেধারছে শিক্ষক হিসেবে অযোগ্য লোকবল নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছেন। এসমস্ত কলেজে নেই কোন নিজস্ব সেমিনার লাইব্রেরী। নেই পর্যাপ্ত শ্রেণী কক্ষ। নেই কোন বৈজ্ঞানিক পরিক্ষা-নিরীক্ষার উপাদান। কলেজের তহবিলে লাখ/কোটি টাকা জমা পড়ে থাকলেও কর্তৃপক্ষ উচ্চশিক্ষার জন্য কোর্স চালু করা ছাড়া আর কোন উন্নয়ন কাজ করতে চায় না। তবে কেন কলেজ কর্তৃপক্ষ এমন হীন চেষ্টায় লিপ্ত থাকছেন? উদ্দেশ্য কী অবহেলিত এলাকার মানুষের মাঝে শিক্ষা বিস্তার? না কি অন্যকিছু। অনুমান করছি যে এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাঁরা এলাকার দরিদ্র মানুষের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ভাবনা দূরে রেখে নিয়োগ বাণিজ্যের পায়তারা করছেন। মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের বিনিময়ে শিক্ষকসহ অন্যান্য লোকবল নিয়োগ দিচ্ছেন। নিয়োগকৃত শিক্ষকবৃন্দ বিনা বেতনে বছরের পর বছর কাজ করে যাচ্ছেন। এমন পেশা মনে হয় আমাদের দেশে আর একটিও নেই যেখানে বিনা বেতনে কারো চাকুরি করতে হয়!

 
অন্যদিকে দেশের জাতীয় শিক্ষাানীতি ২০১০ মোতাবেক উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হবে জ্ঞান সঞ্চারণ ও নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন এবং সেই সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। কার্যকরভাবে বিশ্বমানের শিক্ষাদান, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা জাগানো এবং মানবিক গুণাবলী অর্জনে সহায়তা দান। অবাধ বুদ্ধি চর্চা, মননশীলতা ও চিন্তার বিকাশে সহয়তা দান করা। পাঠদান পদ্ধতিতে সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে দেশের বাস্তবতাকে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা, রাষ্ট্র ও সমাজের সমস্য সনাক্ত করা ও সমাধান খুঁজে বের করা। আধুণিক ও দ্রুত অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে কার্যকর পরিচিতি ঘটানো। জাতীয় জীবনে সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্বদানের উপযোগী বিজ্ঞানমনষ্ক, অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক, মানবমুখী, প্রগতিমীল ও দূরদর্শী নাগরিক সৃষ্টি। কার্যত এসমস্ত কথার সাথে মফস্বলেরর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অধিকাংশেরই পরিচয় নেই। উপর্যুক্ত উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনের জন্য ডিগ্রী কলেজগুলোতে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির পদক্ষেপ নেওয়া হবে এমন কথাও শিক্ষানীতি বলা থাকলেও কেউ তোয়াক্কা করছেন না। টেকসই উন্নয়ন ভাবনার এ যুগে মানবসম্পদ উন্নয়ন বলতে সাধারণত মানুষের জ্ঞানের উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়ন, আর্থিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

 

সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ইউনেস্ক-এর সহয়তায় সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করবার লক্ষ্যে পৃথিবীর নয়টি দেশের শিক্ষামন্ত্রীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এ সম্মেলনে নয় দফা ঢাকা ঘোষণার মধ্যে দিয়ে টেকসই উন্নয়নে শিক্ষার জন্যে এসডিজি-৪ এর লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কয়েকটি আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ঘোষণার দফা ৪.৪ বলা হয়েছে, আইডিয়া ও সংস্কৃতির বিনিময়ের জন্যে স্কলারসীপ, ইন্টার্নশীপ ও আইসিটি শিক্ষার বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকরণ। উচ্চশিক্ষার উন্নয়নের জন্য ই-৯ সদস্যভুক্ত দেশ সমূহের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট থাকবে মর্মে অঙ্গিকার রাখা হয়েছে।

 
সরকারের এতাসব উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও দেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক মহলে রয়েছে নানামাত্রিক আশঙ্কা। এই যেমন, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত শিক্ষক সমিতির এক মতবিনিময় সভায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সেতু ও সড়ক পরিববহন মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদের বলেছেন,“‘আমাদের দেশে এখন শুধু আমরা পরিক্ষার্থী পাই, শিক্ষার্থী পায় না। শিক্ষা হতে হবে জীবনের জন্য, জীবিকার জন্য নয়।” জীবনের জন্য অর্জিত শিক্ষা জীবিকা অর্জনেও সহায়ক, দেশ গঠনেও অসীম ভূমিকা রাখতে পারে। জীবনের জন্য শিক্ষা বলতে নৈতিক বলে বলিয়ান উদ্ভাবনী ও সৃষ্টিশীল শিক্ষা বুঝনো হয়েছে। এ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি সর্বদা মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত থাকবেন এটিই মানুষের প্রত্যাশা। মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানরা এখন শুধু বিল্ডিং চায়, সরকার বিল্ডিং দিচ্ছে। তবে গুণগত শিক্ষা কোথায়? তবে জীবনের জন্য শিক্ষা বাস্তবায়নের দৌড়ে মফস্বলে কলেজসমূহের গন্তব্যমুখ কেমন হবে?

 
মফস্বল কলেজে উচ্চশিক্ষা প্রসারের মান নিয়ে এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে যত্রতত্র প্রাইভেট কলেজ জাতীয়করণ। এজকজন বিসিএস শিক্ষা কর্মকর্তা যতটা যোগ্য শিক্ষক হবেন, জাতীয়করণকৃত ওইসব শিক্ষকের যোগ্যতা তার ধারে কাছে যাবে কিনা সন্দেহ আছে। দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত মানসম্মত উচ্চশিক্ষা প্রসারে দেশের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এখন অনেক এগিয়ে গেছে। বিশ্বমানের নাগরিক তৈরীতে এসকল বিশ্ববিদ্যালয় নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তাই দেশের এ কলেজসমূহে উচ্চ শিক্ষা প্রসারের ব্যাপারে সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের দক্ষ শিক্ষকবৃন্দদের সাথে আন্তঃযোগাযোগ ক্রিয়া বৃদ্ধি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিনিয়ত কলেজ শিক্ষার্থী শিক্ষা বিষয়ক কর্মকান্ড জোরদার করতে হবে। অন্যথায় মফস্বল কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হয়ে একজন শিক্ষার্থী মানব সম্পদ হবার পরিবর্তে অলস, শ্রমবিমুখ ও জাতির বোঝা হয়ে উঠতে পারে।

 
মফস্বল কলেজে উচ্চশিক্ষা প্রসারে যা করণীয় তা হলো, উচ্চশিক্ষা যেহেতু গবেষণা নির্ভর, জ্ঞান সৃষ্টি ও সঞ্চারণের সাথে জড়িত তাই শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য উচ্চতর গবেষণা মানদন্ড হওয়া দরকার। সরকারী তহবিল, এলাকার শিক্ষানুরাগী এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত অর্থ কেেলজের ফান্ডে অলস ফেলে না রেখে শিক্ষা উপকরণ ক্রয় ও গবেষণার জন্য ব্যয় করতে হবে। শিক্ষকদের নিজেদের পেশার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। কলেজসমূহকে জাতয়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল গন্ডি ভেঙ্গে স্থানীয় সুনামধন্য সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিন ন্যাস্ত করতে হবে। নিয়েয়াগ পক্রিয়ায় শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা হোক মানব মুক্তির পথ।

 
লেখক: মো. আবদুল কুদ্দুস
শিক্ষক, বিজনেস স্টাডিজ বিভাগ
ও সহকারী প্রক্টর
নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী
মোবাইল: ০১৭১৭৮৫৪১০৪