‘মনে হচ্ছিল এই বুঝি ধরা পড়লাম’

১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল। সচিবালয়ের ২২ নম্বর টিনশেড থেকে ট্রাংক নিয়ে বের হয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে এসে দেখি, আর্মির জিপ। মেশিনগান তাক করে বসে আছে। বেবিট্যাক্সি নিয়ে ওইখান দিয়ে সোজা চলে আসি।

বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি কেউ ট্রাংকসহ আমাকে ধরে ফেলল। এতে কী আছে—জিজ্ঞেস করলেই তো আমি শেষ। তবে কোনো ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই কার্জন হলের পাশ ধরে চানখাঁরপুল-চকবাজার হয়ে সোয়ারিঘাটে ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছেছি।

এই বর্ণনা ১৯৭১ সালে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলীর। ট্রাংকটির ভেতর ছিল ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণটির মূল কপি, অডিও, ভিডিওসহ সব ডকুমেন্ট। অসীম সাহসিকতায় সেই ট্রাংক তিনি ঢাকার দোহার থানার এক বাড়ির ধানের গোলায় লুকিয়ে রাখেন। ৪২ ইঞ্চির ট্রাংক রক্ষা না পেলে বঙ্গবন্ধুর এ ঐতিহাসিক ভাষণের কোনো ভিডিও চিত্র থাকত না। এ কথা বলছিলেন ঐতিহাসিক ভাষণটির ভিডিও ধারণ করা ও তা রক্ষার দায়িত্বে থাকাদের অন্যতম আমজাদ আলী খন্দকার। তিনি সে সময় ছিলেন চলচ্চিত্র বিভাগের ক্যামেরা সহকারী।

গতকাল সাভার উপজেলার গেণ্ডা এলাকার নিজ বাড়িতে বসে আমজাদ আলী তাঁর সেই মহান দায়িত্ব পালনের কথা শোনান কালের কণ্ঠকে। তিনি বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের ভিডিও চিত্র ধারণ করেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের আট বাঙালি কর্মকর্তা। এটি ডেভেলপের পাশাপাশি সংরক্ষণও করেছিলেন তাঁরা। ২৫ মার্চ কালরাতের পর অবরুদ্ধ ঢাকা শহরের সরকারি দপ্তর থেকে তারা সেই ভিডিওসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট যন্ত্র গোপনে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যান।

মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের সন্তান আমজাদ আলী বলেন, ৭ই মার্চের ভাষণ ধারণ করতে আমাদের পরিচালকের নেতৃত্বে দুই দিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমরা তখন মূলত ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ফিল্ম ডিভিশনের স্টাফ। ফিল্ম ডিভিশনের পরিচালক ছিলেন মোহেব্বুর রহমান খয়ের (প্রয়াত অভিনেতা আবুল খায়ের)। ক্যামেরাম্যান ছিলেন জি জেড এম এ মবিন ও এম এ রউফ। অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলাম আমি, এস এম তৌহিদ আর সৈয়দ মইনুল আহসান। দুজন লাইটবয় ছিল জুনায়েদ আলী ও হাবিব চোকদার। সেদিন কৌশলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ধারণ করে অফিসে ফিরলাম।

ভাষণ রেকর্ড করার পর ডেভেলপ : আমাদের অফিস ছিল সচিবালয়ের ২২ নম্বর শেডে। তখন ডেভেলপ করা হতো এফডিসিতে। সেখানে গেলাম। কিন্তু ফিল্মের ওপরে লিখব কী? সে বছর একটা সাইক্লোন হয়েছিল। তো একটা ফিল্মের ওপর লিখলাম, ‘সাইক্লোন-১’, ‘সাইক্লোন-২’। এভাবে লিখে দিয়ে আমরা ডেভেলপে দিতাম। সেগুলো রক্ষণও আমরাই করতাম।

ভাষণ রক্ষা পেল : আর্মিরা প্রায় সব অফিসের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিল। সচিবালয়ে আর্মির আনাগোনা বেড়ে গেল। এরপর একদিন আমাদের পরিচালক (আবুল খায়ের) ডেকে বললেন, আমজাদ, একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে? কথা মতো সদরঘাট  থেকে ৪২ ইঞ্চির একটি বড় কালো ট্রাংক নিয়ে আসলাম। আনার পর উনি ও আমি ট্রাংকে ভরলাম বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আরো কিছু ছবি ও কাজী নজরুল ইসলামের একটা ডকুমেন্টারিসহ অন্যান্য কিছু জিনিস। এরপর আমাকে তিনি বললেন, এটা নিয়ে আজই যেতে হবে। কোথায় যেতে হবে ঠিকানা দিয়ে দিলেন। আমি বললাম, স্যার আমার বাবার সঙ্গে একটু দেখা করে আসি। তখন স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গেও দেখা করিনি : যদি আটকা পড়ি। ফিরে আসার পর আমাকে আবুল খায়ের রুমের ভেতর নিয়ে গেলেন। আমার হাতটা ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললেন, ‘আমজাদ! আল্লাহ হাফেজ!’ উনি জানতেন, এই ছেলে যদি বের হয়ে ধরা পড়ে, তাহলে তখনই শেষ।

সারা শহরে তখন আর্মির পাহারা

সব জায়গায় তো পাঞ্জাবিরা-বিহারিরা। শুধু ২ নম্বর গেটে একজন বাঙালি সার্জেন্ট ছিলেন ফরিদ। তখন দ্বিতীয় গেট দিয়ে শুধু ঢোকা যায়, বের হওয়া যায় না। তখন ফরিদের সাহায্যে বেবিট্যাক্সি নিয়ে বের হলাম। সোয়ারিঘাটে গিয়ে নৌকায় বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে জিঞ্জিরা গেলাম। সেখানে দেখি, শত শত লোক জীবনের ভয়ে পালাচ্ছে। আর আমি ছুটছি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাঁচাতে। জিঞ্জিরা থেকে বাসে গেলাম বক্সনগরে। এরপর বাস আর যেত না। সেখানে নামার পরে একটা ঘোড়াওয়ালা ঠিক করলাম। ঘোড়ায় ট্রাংক তুলে হেঁটে সেখান থেকে গেলাম দোহার থানার জয়পাড়া মজিদ দারোগার বাড়ি। এদিকে (আবুল খায়ের) খায়ের সাহেব মনে করেছেন, আমাকে ধরে নিয়ে গেছে, মেরে ফেলেছে। আমার যেই বাড়িতে যাওয়ার কথা তিনিও সেদিন সেই বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন। ট্রাংকটা কয়েক দিন ছিল মজিদ দারোগার বাসায়। কিন্তু দারোগা বাড়ির অবস্থান থানার কাছাকাছি হওয়ায় সেখান থেকে ট্রাংকটি সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওখান থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে চর কুসাই গ্রামের উমেদ খাঁর বাড়িতে ট্রাংকটি নিয়ে যাই। তিনি খায়ের সাহেবের আত্মীয়। উমেদ খাঁর বাড়িতে ধানের গোলার ভেতরে ট্রাংকটি লুকিয়ে রাখা হয়। মাসখানেক পর মুক্তি বাহিনীর সহায়তায় ট্রাংকটি ভারতে নেওয়া হয়। দেশ স্বাধীনের  পরপরই দেশে ফিরিয়ে আনা হয় সেই ভিডিও ফুটেজগুলো।

কিছুটা কষ্ট নিয়েই আমজাদ আলী  বললেন, ডিএফপির ক্যামেরা সহকারী হিসেবে যোগ দিই ১৯৬৮ সালে। এর পর ক্যামেরাম্যান হয়ে ১৯৭৪ সালে পদোন্নতি পাই। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগ দিয়ে ২০০৪ সালে বিটিভির কন্ট্রোলার-চিফ ক্যামেরাম্যান হিসেবে অবসরে যাই। ১৯৭৪ সালে ক্যামেরাম্যান হিসেবে পদোন্নতি পেলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আবার বিপদ নেমে আসে আমার ওপর। ১৯৭৯ সালে আমাকে চক্রান্ত করে ফিফথ গ্রেড থেকে ক্লাস থ্রিতে নামানো হয়। এরপর টেলিভিশনে জয়েন করলাম। সেখানে গিয়ে ২৬ মাস বেতন পাইলাম না।

জীবন সায়াহ্নে এসে আমজাদ আলীর (৭৯) সেই আক্ষেপ অনেকটাই ঘুচেছে। এ বছর তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাটাগরিতে একুশে পদক দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়ায় পরিবারের আফসোস রয়েছে।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ