মনিরুজ্জামান শেখ রাহুলের ছোটগল্প ‘প্রিয় কলমটি’

সিল্কসিটিনিউজ সাহিত্য ডেস্ক:
শহরবাসী বাশার নামে এক বালকের কাহিনী। বয়স কতোই বা হবে। এগারো অথবা বারো হবে। গ্রামের মানুষেরা মনে করে শহরের মানুষেরা বিলাসবহুল ও সুখী। কিন্তু এই ধারণা মাঝেমধ্যে অসত্য প্রমানিত হয় শহরে বসবাসরত দরিদ্র শ্রেণির কিছু পরিবারের কাছে। তেমনি এক পরিবারের ছেলে বাশার। গায়ের রং কালো, চুলগুলো এলোমেলো, ছোট ছোট চোখ, নাক মাঝারি ধরণের, ঠোটগুলোও মিসমিসে কালো। যখন হাসে তখন যেন দাঁতগুলোর সাথে মুখভঙ্গি দেখে থমকে যাওয়ার এক মায়া কাজ করে। কিন্তু একটু অগোছালো প্রকৃতির সে। গায়ে ঘষা সাবান কেনা তো দুরের কথা, কাপড় কাঁচার জন্য সপ্তাহে একবার তিন টাকা খরচ করতেও তাদের সমস্যায় পড়তে হতো। তাই তো লোহার উপর মরিচিকা পড়লে যেমন দেখায়, সাবানের অভাবে তার হাত পাগুলো তেমনই।
তবুও জীবন সংগ্রামে লড়াই করে যেতে চায় বাশার। রাজশাহী শহরের এক ছোট্ট এলাকায় থাকে। বাবা দিনমজুর, মা গৃহিনী ও ছোট বোন লতার বয়স চার বছর। খুব কষ্টে দিনযাপন করে তাদের পরিবার।
নিজের পরিবারের এমন অবস্থা ভালোভাবে বোঝে বাশার। সেজন্য তার কোনভাবে দিনযাপন করলেই হলো। ঈদের জমানো পরবির টাকা সে রেখে দেয়। নতুন বছরে সেই টাকা দিয়ে কিছু বই কেনা হবে তার। বাড়ি থেকে স্কুল অনেক দুর। হেটে হেটেই তাকে পাড়ি দিতে হয় স্কুলের রাস্তা।
নতুন বছর। চতুর্থ শ্রেণিতে সপ্তম রোল হয়েছে তার। আজকে স্কুলে যাবে। নতুন বইও হাতে নিবে। সে খুব আনন্দিত। কিন্তু স্কুল ড্রেসটি তার ছোট হয়ে গেছে। নেই জুতাও। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কড়া আদেশ স্কুল ড্রেস ছাড়া কাউকে ক্লাস করতে দেয়া হবে না। বাশারের বাবাকে পাশের বাড়ির কামাল তার ছেলের গত বছরের পুরানো শার্ট ও প্যান্ট দেয়। ওরা তো প্রতিবছর তার সন্তানদেরকে স্কুল ড্রেস বানিয়ে দেয়। প্যাকেট থেকে নতুন জুতা বের করে পায়ে দিয়ে যায় স্কুলে।
কিন্তু বাশারের তো বাড়ন্ত বয়স। যদিও সে চিন্তাভাবনা করেছিল, একটা জামা দিয়েই সে চালিয়ে যাবে, যতদিন হয়। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের কাছে সেটা তো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। কামালের দেয়া স্কুলড্রেসটি গায়ে উঠায় বাশার। সে হালকা-পাতলা গড়নের। তবুও ড্রেসটি তার শরীরে ঠিকঠাক হচ্ছে। প্যান্টের মধ্যে শার্টটা ভালোভাবে ঢুকানো হয়েছে। প্যান্টে তো বেল্ট লাগানো হয় নি। বেল্ট ছাড়া দেখতে কি ভালো লাগে? তাই শার্টকে নিচের দিকে একটু টেনে নামিয়ে দেয়। কোমরে বেল্ট আছে কি নাই সেটা যেন কেউ দেখতে না পারে। আর গত দুইদিন আগে সে তার বাবার সাথে বাজারে যেয়ে ছাড়ে বিক্রি করা একজোড়া জুতা কিনে এনেছে।
শার্ট, প্যান্ট ও জুতা পড়ে আয়নার সামনে দাড়ায় বাশার। চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায় আর দেখে তাকে দেখতে ভালো লাগছে। এরপর স্কুল ব্যাগটি নিতে যায়। ব্যাগটি তার নানীর বাড়ির এক আত্মীয় চার বছর আগে কিনে দিয়েছে। জিন্সের ব্যাগটি দেখতে একটু ময়লা লাগছে। রং ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কিছু কিছু জয়গায় দু-একটা সুতা উঠেছে। তাতে কিছু আসে যায় না, একটা ন্যাকড়া দিয়ে ব্যাগটি মুছে তার মধ্যে খাতা ও কলম ঢুকিয়ে দিয়ে ঘাড়ে নিয়ে দিয়ে রওনা হয় স্কুলের পথে।
স্কুলে ক্লাস শুরু হলো সকাল ১০টায়। প্রথম ক্লাসে সব শিক্ষার্থীদের নতুন বই দেয়া হলো। বাশারও পেয়েছে নতুন বই। খুশির সীমা থাকে না। যদিও তার বত্রিশটি দঁাঁত বের হয় নি, তবে তার হাসিতে মুখের ভেতরের সব দঁাঁতগুলো ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছিলো।
একসময় ক্লাসের বিমলকে দেখে একটি সুন্দর কলম দিয়ে লিখছে। কলমটি প্রথম দেখেই ভালো লেগে যায় তার। বিমলের পাশে গিয়ে বলল, বিমল, তুমি কি লিখছো?
অ্যাজকের অংকগুল্যা করছি।
কলমডা ত খুব সুন্দর ল্যাগছে।
হ্যা, ক্যালকে বাবা বাজার থ্যাকে লিয়ে এ্যাসেছে।
বাজারের কোথায় ব্যাচে রে?
মানিকের আব্বার দোকানে। তুমি কিনবা?
হ্যা, কিনব। দাম কত?
পনের টাকা।
দাম শুনে কলম কেনার আশা খন্ডিত হয় বাশারের। নেত্রে আকর্ষণীয় হওয়া কলমটি কি করে কিনবে। দামও তো অনেক। দরিদ্র পরিবারের নিকট এই পনের টাকাই পনেরশ টাকার সমান। কিভাবে চাইবে তার বাবার কাছে পনের টাকা? স্কুলে টিফিনের জন্য দুই-তিনদিন পর পর সে দুইটা টাকা করে পায় বাবার কাছ থেকে। না, সে তার বাবার কাছে পনের টাকা চাইবে না। মন স্থির করে কলমটি কিনবেই। এক মাসের মধ্যে টিফিনের টাকা জমিয়ে প্রিয় কলমটি কিনবেই, এই তার দৃঢ় সংকল্প।
এতে তেমন কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। একটু সময় লাগবে আর কি। স্কুলে যাওয়ার আগে তার বাবার কাছে যেয়ে ‘আব্বা’ বলে ডাকে। তার বাবা তার দিকে তাকালে মাথা চুলকায় ও দুইটি আঙ্গুল উচিয়ে দেখায়। প্রথমে তার বাবা বুঝতে পারে না। আবারো বাশার তার বাবাকে ডাকে, মুচকি হাসি দিয়ে মাথা চুলকায় আর দুইটি আঙ্গুল দেখায়। তার বাবা বুঝতে পারে যে, বাশার দুই টাকা চাইছে। তার বাবা তাকে দুই টাকা দেয়। বাইরে বের হয়ে দেখে রৌদের তীব্র তাপ। রাস্তার মানুষগুলো যেন তাপে ঝলসে যাচ্ছে। কেউ মাথার উপরে ছাতা দিয়ে হাটছে, আবার চায়ের স্টলে থাকা মানুষগুলো বিভিন্ন বস্তু দিয়ে গায়ে বাতাস লাগাচ্ছে, অন্যদিকে রিক্সাওয়ালাও যেন যাত্রী বহনে ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে যাচ্ছে। তবুও রৌদের তাপকে তুচ্ছ মনে করে, বাশার হাটা শুরু করল স্কুলের দিকে। মাথার ঘাম কোমরে এসে জমা হয়েছে। কিন্তু তাতেও থামছে না বাশার। হেটেই চলেছে, দ্রুত থেকে আরো দ্রুত গতিতে। আজ রৌদের উত্তাপও হার মেনেছে বাশারের কাছে। রাস্তায় হাটার সময় দেখে তার সহপাঠীরা কেউ যাচ্ছে সাইকেলে, কেউ তাদের বাবার বাইকে, আবার কেউ যাচ্ছে চকচকে এসি গাড়িতে। যাই হোক এসব তাকে তেমন কিছু অনুভব করায় না। অবশেষে স্কুলে পৌছালো বাশার। ক্লাসে ব্যাগটা রাখে। ক্লাস শুরু হয়। বিমল আবার সেই কলমটি বের করে। কলমটি আবারো দৃষ্টি কেড়ে নেয় বাশারের। ক্লাস করার ফাকে কিছুক্ষণ পর পর কলমটির দিকে তাকায়। কলমটি যেন তার নিকট একটি আকর্ষণীয় বস্তু হয়ে যায়। তার চোখকে চৌম্বকের মতো আকর্ষিত করে কলমটি। চারটা ক্লাসের পর টিফিন বিরতি। সকালে দুইটা টোস্ট বিস্কুট আর এককাপ চা খেয়ে এসেছে। এখন সে খুবই ক্ষুধার্থ। পকেটে আছে মাত্র দুই টাকা। সে খরচ করবে না। কারন তার লক্ষ্য টাকা জমিয়ে তার প্রিয় কলমটি সে কিনবে। পেটের মধ্যে ক্ষুধার আগুন যেন ক্রমশই বাড়তে থাকে। স্কুলের বট গাছের নিচের একটি উচু জায়গায় বসে নিরব হয়ে থাকে বাশার। এখন সে তার দুই টাকা খরচ করবে না। নইলে তার প্রিয় কলমটি কেনার জন্য টাকা জমানো হবে না। আর ত মাত্র একটা ক্লাস।
ক্লাস শেষে বাড়িতে যেয়েই ভাত খাবে। ক্ষুধার জ্বালাও তাকে সহ্য করতে হবে। সে দেখে স্কুলের অন্য ছাত্ররা পেয়ারা, মুড়িভাজা, আইসক্রীম খাচ্ছে। কিন্তু তাতেও সেগুলো খাওয়ার জন্য তার মনে কোনরুপ ইচ্ছা জাগে না। আজব প্রকৃতির বাশার। এই সহনশীলতা যেন বিশ্বের সকল দুঃখ-কষ্টকেও পরাজিত করে। এমন সময় বাশারের কাছে তার কয়েকজন বন্ধুরা আসে। আসার পর তারা নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। কেউ তার সাথে কথা বলছে না। এমন সময় আপেল বলল, বাশার যাও তুমি ভাজা লিয়ে এ্যাসো, তুমি আর আমি দুইজনেই খাবো। বাশারের মুখে হাসি ফোঁটে। তাকে তার দুই টাকা খরচ করতে হলো না। দুই টাকা নিয়ে দৌড়ে চলে যায় ভাজাওয়ালার কাছে। ভীড়ের মধ্যেও সে তাড়াতাড়ি করে ভাজা নিয়ে এসে আপেলকে দেয়। আপেল কাগজের ঠোঙ্গার মধ্যে থাকা প্রায় সবটুকু ভাজা খেয়ে বাশারকে কয়েকটা তেলে মুড়ি দেয়। বাশার অবাক হয়। ভ্রু কুচকিয়ে ঠোঙ্গার দিকে তাকায়, এক ঢোক চাপে। মন খারাপ হয়ে যায় তার। প্রচন্ড ক্ষুধার্থ অবস্থায় আছে সে, মনে করেছিল এবার কিছু খাবে। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না। বাধ্য হয়েই সে ওই কয়েকটা তেলে মাখা মুড়ি খায়। কি আর করবে? এতে যদি তার পেটের মধ্যে জ্বলতে থাকা ক্ষুধার আগুনের তীব্রতা কিছুটা কমে। এরপর সে পানি খেয়ে চলে যায় ক্লাসে। এভাবে চলতে থাকে বাশারের প্রিয় কলম কেনার জন্য টাকা জমানোর প্রচেষ্টা। কিছুদিন পর সে ছয় টাকা জমিয়ে ফেলে।
একদিন ক্লাস শেষে বাড়িতে ফেরার পথে স্কুলের মধ্যে থাকা করমচা গাছের দিকে চোখ যায় বাশারের। গাছে করমচা ধরেছে। বেশ বড় হয়েছে। তার সাথেই হাটছিলো বিমল। সে বিমলকে বলে করমচা খাবে নাকি। বিমল হ্যা সূচক মাথা ঝোকায়। এরপর তারা করমচা গাছের নিচে যায়। কয়েকটা করমচা পাড়ে দুইজন মিলে। করমচা পাড়ার পর দেখে সেগুলোর আগা থেকে সাদা রস বেরিয়ে আসছে। দেখতে ভালো লাগলেও একবার যদি কাপড়ে লেগে যায় তাহলে বিপদ। দাগ মেটানোই দায়।
বাশার সেটা জানে, তাই সে ব্যাগ থেকে খাতাটা বের করে একটা পাতা ও করমচাগুলো সেখানে রাখে। আরো বেশি করে পাড়ে, তার বোনের জন্য। বাড়িতে যেয়ে তার বোনকে ডাকে। লতা, কই রে। এদিক আয়।
বাশারের ডাক শুনে তার বোন দৌড়ে আসে।
কি গো, ভাইয়া।
এই দ্যাখ, কি এনেছি। (করমচাগুলো দেখিয়ে বলে)
কি এ্যাগল্যা?
করমচা, পানি দিয়্যা ধুয়্যা লিয়ে খা গা।
লতা এক কামড় দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। খুবই টক, সে কি আর করবে। ছোট মানুষ। লতাকে দেখে বাশার বলে……………….
লবন দিয়্যা খা গা। এইভাবে খ্যালে টক ত ল্যাগবেই।
কিছুক্ষণ পর লতা বলে……..
ওই ভাইয়া শুনো। সুমি না, লম্বা কাঠিতে লাগানো চকলেট খাচ্ছিলো। তুমি ওই চকলেট কিন্যা দ্যাও না।
ঠিক আছে। কিন্যা লিয়ে আসছি।
বাশার তার বোনকে খুব ভালোবাসে। চকলেটের দাম তো মাত্র দুই টাকা। ছয় টাকা থেকে দুই টাকা কমলে খুব একটা কমবে না। আবারো সে টাকা জমিয়ে নেবে। লতাকে সে চকলেট কিনে এনে দেয়। লতা খুব খুশি। বোনের খুশিতে বাশারও খুব খুশি হয়।
কলমটি প্রতিচ্ছবি যেন তার পিছু ছাড়ে না। সবসময় চোখের সামনে ভেসে উঠে কলমটি। রাত্রে ঘুমানোর সময় স্বপ্নতেও চলে আসে। এভাবে কিছুদিন চলতে থাকে বাশারের। একদিন স্কুলে ক্লাস শেষে বাড়িতে আসার পর পকেট থেকে কয়েনগুলো বের করে। কয়েন তো নয়, সেগুলো তার জীবনের তিলে তিলে জমানো মূল্যবান সম্পদ। ভালোভাবে গুনে দেখে দশ টাকা জমানো হয়েছে। অত্যন্ত খুশি বাশার। এই খুশির কোন অন্ত নেই। আর মাত্র পাঁচ টাকা হলেই কিনতে পারবে কলমটি। আর সহ্য হচ্ছে না। অনেক দিনের স্বপ্নে আনাগোনা দেয়া শখের কলমটি এবার সে কিনবে। মনে মনে ভাবে যদি কালকে টিফিনের জন্য পাঁচ টাকা পেত, তাহলে হয়ত কালকে কলমটি কেনার জন্য রওনা হতো। কিন্তু সে সামর্থ্য নেই বাশারদের। পরের দিন তার বাবার কাছ থেকে দুই টাকা নিয়ে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যায় তাদের বাড়িতে আসে ছোট চাচা। অনেক দিন পরে বাশারকে দেখে, মনে ভালোলাগা কাজ করে। মোড়ে নিয়ে যেয়ে তার ছোট চাচা তাকে চা বিস্কুট খাওয়ায়। চাচার কাছে সে একটাকা চায়। চাচা পকেটে হাত দিতেই সে আবার বলে, আপনি আমাকে তিন টাকা দিতে প্যারব্যান? আমার খুব দরকার। দ্যান না চাচা। একবার দ্যান। আর কখনই আপনার কাছে টাকা চাহাব না।
চাচা অবাক হয়ে বাশারকে বলে, এভাবে বলছিস ক্যান। আমি কি কখনও তোকে না করেছি।’
বাশার কোন কথা না বলে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে। চাচা আবার বলে, কি করবি তুই তিন টাকা?
বাশার তখন তার প্রিয় কলম কেনার জন্য টিফিনের টাকা জমানোর সব ঘটনা বলে। এসব কথা শুনে বাশারের চাচার শরীর শিহরিত হয়। কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে তিনটাকা বের করে বলে, এই ল্যা। যা তোর কলম কিনগা। আর কলম কিন্যা এ্যানে সবার আগে আমাকে দ্যাখাবি, ঠিক আছে।
হাতে টাকা নিয়ে খুশি হয় বাশার। আনন্দে লাফালাফি করতে ইচ্ছে করছে। তবে মনের মাঝে ইতোমধ্যে লাফালাফি শুরু হয়ে গেছে। হয়ে গেল ত পনের টাকা। কলমটির জন্য তাকে আর স্বপ্ন দেখতে হবে না। বাবার কাছে টিফিনের টাকার জন্য মাথা চুলকাতে হবে না। ক্লাসে তাকাবে না বিমলের হাতের দিকে। টিফিনে ক্ষুধার আগুনের জ্বালাও নিবারন করবে। সবকিছুর অবসান হলো এবার।
ক্লাস শেষে বাজারের দিকে যাবে বাশার। অনেক দুরের রাস্তা। বাজারের দিকে যাবে এইরকম সাইকেল চড়ে যাওয়া বন্ধুদের বলে তাকে একটু বাজারে নিয়ে যেতে। কিন্তু কেউ তাকে বাজারে নিয়ে যেতে যায় না। সবাই বলে সে অনেক অগোছালো। তাকে সাইকেলে নিলে তাদের সাইকেল ময়লা হয়ে যাবে।
এসব কথা শুনে বাশার উদাস হয় না কারন তার মনে সেই কলম কেনার আনন্দ এখনও আছে। অবশেষে রওনা দিলো বাজারের দিকে। অনেক রাস্তা পায়ে হাটার পর দোকানের সামনে যায়। কিনে নেয় হীরকের চেয়েও মূল্যবান কলমটি। আকর্ষণীয় মোড়কের মধ্যে থাকা কলমটির সৌন্দর্যের ছটা বাশারের চোখে আনন্দের দৃষ্টি বহুগুনে বাড়িয়ে দেয়। মুখে যে হাসি নেই, তা নয়। মুচকি হাসি হাসছে, কিন্তু এই হাসির মধ্যেও লুকিয়ে আছে বিশ্বের সকল সুখ। কলমটির নিয়ে তার বাড়িতে চলে যায়। বাড়িতে যেয়ে দেখাতে শুরু করে তার বাবাকে, মাকে ও তার ছোট বোনকে। বাবা, মা তাকে জিজ্ঞাসা করে কলমের দাম কত? উত্তরে বলে পনের টাকা। অবাক হয়ে মা তাকে আবার বলে কোথায় থেকে টাকা পেল। এবার বলে সে তার টাকা জমানোর প্রচেষ্টার মুহূর্তগুলো। কতই না কষ্ট করে সে টাকা জমিয়েছে, কলমটি কেনার জন্য।
সেই কষ্টের ফল স্বরুপ সে অর্জন করেছে স্বপ্নের স্বর্ণফলটি। বাবা হেসে বলে, খুব ভালো। কলমটা দা ত ভালো ল্যাগছে। এরমধ্যেই তার বন্ধু বিমল আসে তার বাড়িতে। আজ তার জন্মদিন। তাই দাওয়াত দিতে এসেছে বাশারকে। বাশার যাবে না জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। কিন্তু বিমলের নাছোরবান্দা অনুরোধে সে সিদ্ধান্ত নেই, যাবে। সবাই ত তাকে ময়লা বলে ও সেই নজরেই দেখে। আজ বাশার সবার কাছে ছোট চাই না। কারও ঘৃণার, হাসাহাসি ও উপহাসের পাত্র হতে চাই না। তাই সে আগের পুরানো ফুলহাতা শার্টটা ভালোভাবে ধুতে যায় নদীতে। ফুল প্যান্ট ত পড়বেই, ফুল শার্ট পড়লে তার হাত-পা এর বর্ণ কেউ দেখতে পারবে না। শার্ট-প্যান্ট পড়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে তার মনে উদিত হলো কি যেন কমতি রয়ে গেল।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে, অনুষ্ঠানে গেলে ত কিছু উপহার নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু কি উপহার দিবে বিমলকে? উপহার কিনতে টাকা লাগবে। তাহলে? অনেক চিন্তা করে। কিন্তু না, কোন উত্তর পেল না। হঠাৎ তার চোখ যায় কলমটির দিকে। তাহলে কলমটি? না, এটা কেনার জন্য অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে বাশারকে। শরীর থেকে রক্ত ক্ষয় করার মত অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয়েছে কলমটি কেনার জন্য। যদি কোন উপহার না নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে বাশারকে অনেকের কাছে অপমান হতে হবে। অনেকটাই বিষন্ন মনে হাত বাড়ায় কলমটির দিকে। তারপর যাত্রা শুরু করল বিমলের বাড়ির দিকে। যাবার সময় তার পা যেন চলছিলো না। মাটির সাথে কামড়ে থাকছে। আজ প্রিয় কলমটির হারিয়ে দেয়ার দুঃখের ভার সে সহ্য করতে পারছে না। অনেক কষ্টে অনুষ্ঠানে যেয়ে বিমলকে আড়ালে ডেকে বলে তার কোন সামর্থ্য নেই। আজ গরিব ঘরের সন্তান বলে পরিবারের সদস্য ছাড়া কেউ তেমন তাকে ভালোবাসা না। একমাত্র বিমল তার ভালো বন্ধু। এর পর পকেট থেকে বের কলমটি।
বিমল দেখে বলে কলমটি কিনেছ।
কান্নাকন্ঠে উত্তর আসে, হ্যাঁ কিন্যাছি। অনেক কষ্ট কর‌্যা কিন্যাছি। তোমাকে আমার পক্ষ থ্যাকে এই উপহার।
কলমটি দেয়ার সময় বিমল অনেক না করলেও বাশার তাকে জোড়াজুড়ি করে কলমটি দেয়। তারপর বাশার বলে আমি আবার টাকা জমাবো। কলম তো কেনা হবেই। কলমটি দেয়ার সময় তার হাতের মাংসপেশী চেপে ধরছিলো। বাম হাত দিয়ে বিমলের হাত ধরে কলমটি দিয়ে দেয়। এরপর বিমল তাকে খেতে দেয়। অল্প একটু খেয়ে বলে পেট ভরে গেছে। হয়ত হতাশাই তার পেটের ক্ষুধা অগ্নি নিভে গেছে। কিছু সময় পর বাজারের দিকে ছুটে আসে বাশার। দোকানে থাকা প্রিয় কলমটির দিকে আবারো চোখ মেলে। বুকের মধ্যে কান্না আর আটকে থাকতে পারছে না। হু হু করে তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ধীরে ধীরে বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমা হয় দু-চোখ জুড়ে। উপরের দাঁত দিয়ে নিচের ঠোটকে কামড়ে ধরে। গালে কান্নার কম্পন দেখা যাচ্ছে। বারবার চোখ মুছতে থাকে, কিন্তু প্রিয় কলমটির থেকে তার দৃষ্টি সরছে না।