মঙ্গলাভিযান : মহাকাশ গবেষণায় আরেক ধাপ এগুলো চীন

উন্নত দেশগুলোর তুলনায় চীন মহাকাশ নিয়ে গবেষণা শুরু করে অনেক পরে। এর কারণও বোধগম্য। চীনের কোটি কোটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা ছিল নয়াচীনের বিভিন্ন সময়ের নেতৃবৃন্দের প্রথম ও মূল কাজ। সেই কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করার ওপরই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। জনগণের অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, ও শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে চীনের সরকার দারিদ্র্যবিমোচনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। আর এক্ষেত্রে চীন অর্জন করে অভূতপূর্ব সাফল্য। মাত্র কয়েক দশকে প্রায় একশ কোটি মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে।

দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য চীনকে তার অবকাঠামো উন্নত ও বিস্তৃত করতে নিরলসভাবে কাজ করতে হয়েছে। এ খাতে বিপুল সম্পদও বিনিয়োগ করতে হয়েছে। দেশের চিকিৎসা-ব্যবস্থাকে আধুনিক করে গড়ে তোলা এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ব্যাপারটিও ছিল অগ্রাধিকার তালিকার শুরুর দিকে। অগ্রাধিকার তালিকার শুরুতে আরও ছিল শিক্ষা। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ওপর শুরুতে বেশি গুরুত্ব দেয়। পাশাপাশি চলেছে উচ্চশিক্ষা-ব্যবস্থাকে উন্নত থেকে উন্নততর করার কাজ। বৈজ্ঞানিক গবেষণাও এগিয়েছে পাশাপাশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চীন গবেষণায় অল্প সময়ে ছাড়িয়ে গেছে উন্নত বিশ্বকেও। এক্ষেত্রে সুপারকম্পিউটারের কথা উল্লেখ করা যায়।

মহাশূন্যে নিজের নভোচারী পাঠানোর পর চীন আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। চীনের মহাকাশ-গবেষণা এগিয়ে গেছে ও যাচ্ছে দুর্দান্ত গতিতে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের অক্টোবরে, মনুষ্যবাহী মহাকাশযান ‘শেনচৌ ৬’ উৎক্ষেপণ করে চীন। এবার মহাশূন্যে পাড়ি জমান চীনের দুই জন নভোচারী (ফেই চুনলং এবং নিয়ে হাইশং)। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে মহাশূন্যে পাঠানো হয় ‘শেনচৌ ৭’। পরে ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে, ‘থিয়ানকং ১’ (TiangongⅠ) স্পেস মডিউল বা মহাকাশযন্ত্র এবং ‘শেনচৌ ৮’, ‘শেনচৌ ৯’ ও ‘শেনচৌ ১০’ মহাকাশযান একে একে মহাশূন্যে পাঠানো হয়। এ সময় চীনা মহাকাশ-বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো ‘স্পেস ডকিং’-এ সক্ষম হন (‘স্পেস ডকিং’ হচ্ছে মহাশূন্যে বিদ্যমান কোনো মহাকাশযানের সঙ্গে অন্য একটি মহাকাশযানকে সংযুক্ত করা)। মহাকাশ-গবেষণা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। চীনা মহাকাশ-বিজ্ঞানীরা পর্যায়টি সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করেন।

২০১৬ ও ২০১৭ সালে চীনের মহাকাশ-গবেষণায় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জিত হয়। এই দুই বছরে চীন একের পর এক মহাশূন্যে পাঠায় ‘থিয়ানকং ২’ মহাকাশ-গবেষণাগার, ‘শেনচৌ ১১’ মনুষ্যবাহী মহাকাশযান, ও ‘থিয়ানচৌ ১’ (Tianzhou Ⅰ) মালবাহী মহাকাশযান। ওই দুই বছর মহাকাশে ধারাবাহিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান চীনের মহাকাশ-বিজ্ঞানীরা এবং মনুষ্যবাহী মহাকাশযান প্রেরণ, মহাশূন্যে পদচারণা বা স্পেস ওয়াকিং, স্পেস ডকিং, মহাশূন্যে নভোচারীদের মধ্য-মেয়াদি অবস্থান, মহাশূন্যে মালবাহী মহাকাশযান প্রেরণ, ইত্যাদি ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। আর এ সবকিছু মহাশূন্যে চীনের নিজস্ব একটি মহাকাশকেন্দ্র (space station) নির্মাণের পথ প্রশস্ত করেছে। পরিকল্পনা অনুসারে, ২০২২ সালের মধ্যেই চীনের প্রথম মহাকাশকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষ হবে।সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর চীন হবে তৃতীয় রাষ্ট্র যার নিজস্ব মহাকাশকেন্দ্র থাকবে।

মহাকাশে মনুষ্যবাহী মহাকাশযান প্রেরণের প্রকল্প গ্রহণের পর ২৫ বছরের বেশি সময় কেটে গেছে। এই ২৫ বছরে চীন সবমিলিয়ে ১১টি শেনচৌ মহাকাশযান, দুটি মহাকাশ-গবেষণাগার, ও একটি মালবাহী মহাকাশযান মহাশূন্যে পাঠিয়েছে। এসময় চীনের রেকর্ডসংখ্যক ১৪ জন নভোচারী মহাশূন্যে পাড়ি জমিয়েছেন; সেখানে গিয়ে গবেষণা করেছেন এবং নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরেও এসেছেন।

মনুষ্যবাহী মহাকাশযান নিয়ে চীনের গবেষণা অব্যাহত আছে ও থাকবে। পাশাপাশি, চাঁদ, মঙ্গল, ও বিভিন্ন গ্রহাণুতে মহাকাশযান পাঠানোর বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগুচ্ছেন দেশটির মহাকাশ-বিজ্ঞানীরা। ২০০০ সালের ২২ নভেম্বর চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ তথা মন্ত্রিসভার তথ্য-কার্যালয় থেকে দেশের মহাকাশ-গবেষণা নিয়ে প্রথমবারের মতো একটি শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়। শ্বেতপত্রে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘চন্দ্র-গবেষণার ওপর ভিত্তি করে, গভীর-মহাকাশ নিয়ে প্রাথমিক গবেষণার কাজ শুরু করা হবে’। ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে সরকার চন্দ্র-অনুসন্ধান প্রকল্প অনুমোদন করে। শুরু হয় গভীর মহাকাশ নিয়ে গবেষণার কাজ।

চীনের চন্দ্র-অনুসন্ধান কার্যক্রমকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়: প্রথম পর্যায়ে অনুসন্ধান-উপগ্রহ কর্তৃক চন্দ্র-প্রদক্ষিণ; দ্বিতীয় পর্যায়ে চন্দ্রযানের চাঁদের বুকে অবতরণ এবং তৃতীয় পর্যায়ে মনুষ্যবিহীন চন্দ্রযানের চাঁদের বুকে অবতরণ ও পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন। গোটা প্রক্রিয়াটি মোটামুটি এমন: প্রথম দিকে অনুসন্ধান-উপগ্রহ চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে ও পরবর্তী পর্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবে। পরে এসব তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে চীনের চন্দ্রযান চাঁদের বুকে অবতরণ (soft landing) করবে। এ যাত্রা হবে একমুখী বা ওয়ান ওয়ে। চন্দ্রযানকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে না, বরং সেটি চাঁদের বুকে পূর্বনির্ধারিত গবেষণা চালাবে এবং পরবর্তী পর্যায়ের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করবে পৃথিবীতে। আর চূড়ান্ত পর্যায়ে চন্দ্রযানকে চাঁদের বুকে অবতরণ করানো হবে এবং প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহের পর পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে। এখন পর্যন্ত চীন প্রথম দুটি পর্যায় সফলভাবে শেষ করেছে।

২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর চীনের প্রথম চন্দ্র-অনুসন্ধান কৃত্রিম উপগ্রহ ‘ছাংও ১’ (Chang’eⅠ) উৎক্ষেপণ করা হয়। ৫ নভেম্বর, দীর্ঘ যাত্রাশেষে, বেইজিং সময় বেলা ১১টা ৩৭ মিনিটে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে ‘ছাংও ১’ এবং চাঁদকে প্রদক্ষিণ করা শুরু করে। চন্দ্র-অনুসন্ধানের দীর্ঘ যাত্রায় প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করে চীন। নিজের পূর্বনির্ধারিত কাজ শেষ করার ১২৭ দিন পর চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ে ‘ছাংও ১’। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে উপগ্রহটি চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পৃথিবীতে পাঠায়।

এরপর চীন একে একে ‘ছাংও ২’ ও ‘ছাংও ৩’ চাঁদে পাঠায়। এই তিনটি উপগ্রহকে ডাকা হয় ‘তিন ফুল-বোন’ বলে। চাঁদে চন্দ্রযানের সফ্ট ল্যান্ডিংয়ের সম্ভাব্যতা ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি যাচাই করার কাজটি সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করে ‘ছাংও ২’। আর এই কাজ করতে গিয়ে উপগ্রহটি ৭ কোটি কিলোমিটারের বেশি পথ (পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব এবং চন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করার সময় অতিক্রান্ত দূরত্বের যোগফল) অতিক্রম করে। এর আগে চীনের কোনো মহাকাশযান এতো বেশি পথ অতিক্রম করেনি। এর পর ‘ছাংও ৩’ চাঁদের বুকে অবতরণ করে, যাকে কেতাবি ভাষায় বলে ‘সফ্ট ল্যান্ডিং’। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর চীন তৃতীয় দেশ হিসেবে এ সাফল্য অর্জন করে। তবে, ‘ছাংও ৩’ চাঁদের বুকে কর্মঘন্টার হিসেবে আগের দুই দেশের চন্দ্রযানগুলোকে পেছনে ফেলে, তথা বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করে। এই ‘তিন ফুল-বোন’-এর সম্মিলিত সাফল্যের ফলে চাঁদের বুকে মহাকাশযান নামিয়ে, সেটি আবার পৃথিবীতে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার প্রযুক্তি আয়ত্ত করে চীন। পরে, চাঁদের দূরবর্তী অন্ধকার অঞ্চলে ‘ছাংও ৪’ অবতরণ করিয়ে মহাকাশ-গবেষণার ক্ষেত্রে আরেকটি রেকর্ড করে দেশটি। পরিকল্পনা অনুসারে, ‘ছাংও ৫’ চাঁদের বুকে অবতরণ করবে এবং প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরে আসবে। এ ক্ষেত্রে চীনের পরবর্তী লক্ষ্য চাঁদে মনুষ্যবাহী মহাকাশযান পাঠানো।

এদিকে, চাঁদ ছাড়িয়ে মঙ্গলের দিকেও নজর দেয় চীন। বিগত ২৩ জুলাই চীনের মঙ্গল মিশন শুরু হয় সাফল্যের সাথে। এর আগে জুলাইয়ের শুরুতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি মঙ্গল-অনুসন্ধানযান মহাশূন্যে পাঠানো হয়। আর ৩০ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র পাঠায় তার আরেকটি মঙ্গল-অনুসন্ধানযান। প্রতি ২৬ মাস পর পর মঙ্গল গ্রহ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে চলে আসে। জুলাই মাসটি ছিল সে সময়। তাই তিনটি দেশই এই মাসটি বেছে নেয় মঙ্গলযান উৎক্ষেপণের জন্য।

আমিরাতের মঙ্গলযান উৎক্ষেপণ করা হয় জাপান থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে আমিরাতকে গবেষণায় সাহায্য করেছে। আমিরাতি মঙ্গল-মিশনের লক্ষ্যও সীমিত। তাদের অনুসন্ধানযানটি মঙ্গলকে স্রেফ প্রদক্ষিণ করবে ও বিভিন্ন ছবি ও উপাত্ত পাঠাবে। এই যানটি মঙ্গলপৃষ্ঠে অবতরণ করবে না। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মঙ্গল-অনুসন্ধানযান ‘পারসিভিয়ারেন্স’-এর লক্ষ্য বিস্তৃত। এটি মঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করবে, মঙ্গলে অবতরণ করবে ও মঙ্গলের বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করবে। ভবিষ্যতে এই নমুনা পৃথিবীতে আনার পরিকল্পনা আছে নাসার। যুক্তরাষ্ট্রের মঙ্গল-মিশনে এবার একটি ড্রোন হেলিকপ্টারও পাঠানো হয়েছে। এই ড্রোনটি মঙ্গলের উপরে উড়বে ও ছবি তুলবে। যুক্তরাষ্ট্রের আগের মঙ্গল-মিশনগুলোতে এমন ড্রোন-হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়নি। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র সাফল্যের সঙ্গে চার বার মঙ্গলে অনুসন্ধানযান (সোজার্নার, স্পিরিট, অপরচুনিটি, ও কিউরিওসিটি) পাঠায়।

চীন তার মঙ্গল-অনুসন্ধানযান ‘থিয়ান ওয়েন-১’-কে সাফল্যের সঙ্গে মহাশূন্যে নিক্ষেপ করে ২৩ জুলাই। বস্তুত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে, মঙ্গল-অনুসন্ধানে চীন অনেক পিছিয়ে আছে। এরপরও, চীনের মঙ্গল-মিশনকে ‘উচ্চাভিলাষী’ বলে আখ্যায়িত করছেন পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা। কারণ, চীনের মঙ্গল-মিশনে একইসঙ্গে তিনটি লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করা হবে: অনুসন্ধানযান মঙ্গল গ্রহকে প্রদক্ষিণ করবে; একটি অবতরণ-যান মঙ্গলের মাটিতে নামবে এবং একটি রোভার মঙ্গলের মাটিতে চলাফেরা করবে। দেখার বিষয়, এই তিনটি লক্ষ্য সাফল্যের সঙ্গে অর্জিত হয় কি-না। এটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে প্রায় ৭ মাস। কারণ, তিনটি দেশের তিনটি মঙ্গল-অনুসন্ধানযান প্রায় ৭ মাসের মহাশূন্য-ভ্রমণশেষে মঙ্গলে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

চীন মহাকাশ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে তুলনামূলক দেরিতে। তবে, অল্পসময়ের মধ্যে এক্ষেত্রে দেশটি অনেক উন্নত দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে। মঙ্গল-মিশন সফল হলে যুক্তরাষ্ট্রের পর এক্ষেত্রে চীন হবে বিশ্বের দ্বিতীয় সফল দেশ। কিন্তু এ মিশনই চীনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। বিভিন্ন গ্রহাণু ও বৃহস্পতি সম্পর্কে ২০৩০ সালের মধ্যেই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে মহাকাশযান পাঠানোর পরিকল্পনা আছে চীনের। চীনের চূড়ান্ত লক্ষ্য মহাকাশ-গবেষণায় বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশে পরিণত হওয়া।