ভ্রমন পিপাসুদের কাছে মিনি কক্সবাজার “নাটোরের চলনবিল”

সিংড়া প্রতিনিধি:
দেশের বৃহত্তম বিল নাটোরের সিংড়ার চলনবিল এখন ভ্রমন পিপাসুদের কাছে “মিনি কক্সবাজার” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এছাড়াও চলনবিলের পাশাপাশি নলডাঙ্গা উপজেলার একপ্রান্তে প্রায় ৪০ হাজার একরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে হালতিবিল। নাটোর শহরের পুরোনো বাসষ্ট্যান্ড ও সিংড়ার চলনবিল গেটে পৌঁছালেই শোনা যাবে সিএনজি, অটোরিকশা চালকদের হাঁকডাক— ঘুরে আসি এই কক্সবাজার! এই কুয়াকাটা!

প্রথমটা একটু চমকে যেতে হয়। পরে চমক ভাঙে। না, আসলে এখানে কক্সবাজারের ছিটেফোঁটাও নেই। আছে এক বিল, যা নাম কিনেছে দেশের ওই জনপ্রিয় সাগর সৈকতের। বর্ষায় বিস্তৃত জলরাশি আর অজ পাখ-পাখালীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করার পাশাপাশি নৌকা ভ্রমনের আনন্দ পেতে প্রতিদিন হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু মানুষের উপস্থিতি মুখরিত হয়ে উঠে চলনবিল। যথাযথ তত্তাবধান ও পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে উত্তর জনপদের ঐতিহ্যবাহী এই চলনবিল ও হালতিবিল একটি আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
নাটোর শহর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার উত্তরে পাটুলঘাটে চলনবিলের একটি অংশ হালতিবিল ও বিশ কিলোমিটার উত্তরে সিংড়া-বারুহাস-তাড়াশ দুবন্ত সড়ক (কবিরগঞ্জ পার্ক) এলাকার একটি অংশ চলনবিলের ডুবন্ত সড়ক নামে পরিচিত। দুই বিলের মধ্যে রয়েছে কংক্রিটের তৈরি সমতল সড়ক। ভারী বৃষ্টি ও বন্যায় সড়ক দুইটিই তলিয়ে যায়। তখন চারদিকে শুধু পানি আর পানি। এই সময়টা এলেই মন ছুটে চলে, যেদিকে চোখ যায় শুধুই অথৈই জলরাশি। মাঝে মাঝে দিগন্ত রেখায় সবুজের কারুকাজ ও দ্বীপের মতো বেশ কিছু গ্রামও চোখে পড়ে। ওই সময় ডিঙি নৌকায় বিলে ভেসে বেড়াতে গেলে মন ভরে যায়।

পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে চলনবিলের এই আনন্দ উপভোগ করতে এসেছেন অনেকেই। কেউবা এসেছেন ব্যক্তিগত গাড়িতে, কেউ অটোরিকশা, ট্যাক্সি, নছিমন বা ভটভটি ভাড়া করে। সড়ক ধরে মাইলের পর মাইল হাঁটছেন। দুই পাশ থেকে ঢেউ আছড়ে পড়ছে পথিকের পায়ে। যেন যত্ন করে পা ধুয়ে দিচ্ছে। চারদিকে স্রোতের কলকল শব্দ আর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের ডাক।

পাটুলঘাট থেকে সিংড়া-বারুহাস-তাড়াশ সড়ক এর দুরত্ব মাত্র ১১ কিলোমিটার। এ সড়কটিও চলনবিলের তলি দিয়ে তৈরি। বিলের পানি বাড়লে রাস্তা ডুবে যায়। তখন নৌকা চলে। খোলা বাতাসে বিলের ঠান্ডা পানিতে পা ভেজাতে এখানেও ভিড় করেন মানুষ। বিকেলেই ভিড় বেশি হয়। ইচ্ছা করলে এখানেও ঘন্টার পর ঘন্টা নৌকায় ঘুরে বেড়ানো যায়। স্থানীয়রা চলনবিলের এই অংশের নাম দিয়েছেন ‘কুয়াকাটা সৈকত’।

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪১ বছর পর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জুনাইদ আহমেদ পলক চলনবিলবাসীকে উপহার দেন সিংড়া-বারুহাস-তাড়াশ এই ডুবন্ত সড়কটি। ইতোমধ্যে চলনবিলবাসীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সহ চলনবিলে পর্যটকদের সুবিধা বাড়াতে তিনি নানা মূখী পদক্ষেপও গ্রহণ করেছেন।

নাটোর থেকে সপরিবারে এসেছেন তোফাজ্জল হোসেন। তিনি বলেন, ‘লোকমুখে প্রশংসা শুনে এখানে এসেছি। আসার পর এখানকার সৌন্দর্য্য দেখে অবাক লাগছে। মনে হচ্ছে, সত্যিই যেন কক্সবাজার এসেছি। পরিবারের লোকজন প্রতিনিয়তই আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।’

বগুড়ার নন্দীগ্রামের দিনমজুর করিম মিয়া বলেন, ‘সারা বছর দিনমজুরি দিয়া খাই। আমাদের তো আর কক্সবাজার যাওয়ার সামর্থ্য নাই। তবে সামান্য খরচে যা দেখছি তা টেলিভিশনে দেখা ক´বাজারের চেয়ে কম কী?’ কেমন খরচ হয়েছে জানতে চাইলে করিম মিয়া হাসিমুখে বলেন, ‘নন্দীগ্রাম শহর থেকে মাত্র ২০ টাকা ভাড়ায় অটোরিকশায় এখানে আইছি। আর অন্যদের সাথে নৌকার ভাড়া দিছি ২৫ টাকা। এই তো খরচ!’
স্বল্প আয়ের মানুষেরাই বেশি আসেন এখানে। সাধ্যের মধ্যে খুঁজে পেতে চান স্বস্তি ও সুখ। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আসেন।


চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সভাপতি ও বিলহালতি ত্রিমোহনী কলেজের ভুগোল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বললেন ‘আমি কক্সবাজারসহ অনেক জায়গায় ঘুরেছি। তার মধ্যে এখানকার সৌন্দর্যটা অন্য রকম। এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা অল্প খরচে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ঘোরা যায়। তবে এখানকার বড় সমস্যা, এখানে থাকা ও খাওয়ার ভালো হোটেল নেই। আর কিছু অবৈধ্য দখলদার ও যত্রতত্রভাবে পুকুর খননের কারণে চলনবিল তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এতে ভবিষ্যৎতে এই বিল পর্যটক শুন্যতা দেখা দিতে পারে বলে তিনি আশংখা করেন।

সিংড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, চলনবিলে স্বাচ্ছন্দে বেড়ানোর জন্য নিরাপত্তার দিকে বিশেষ নজর রাখা হয়েছে। সাদা পোশাকের ফোর্স সহ পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য টহলে রাখা হয়েছে।

স/অ