ভোটের খরায় স্বাভাবিকতা-অস্বাভাবিকতা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের যে নির্বাচন হয়েছে তাতে নগণ্যসংখ্যক ভোটার উপস্থিতির বিষয়টি বিশ্লেষক ও সমাজচিন্তকদের স্তম্ভিত করেছে। স্বাধীনতাপূর্বকাল থেকেই এ অঞ্চলে ভোটে নানা ধরনের অনিয়ম-জালিয়াতি হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ ও ভোটাররা এ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিকে নমনীয় দৃষ্টিতে দেখেছে।

বলা যায়, ভোটে অনিয়ম-দুর্নীতি তাদের গা-সহা হয়ে গেছে। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে যে কিছু না কিছু অনিয়ম-দুর্নীতি, জালিয়াতি হবে সাধারণ ভোটাররা তা ধরেই নিয়েছিল। তবে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) স্থাপনের ফলে অনিয়ম-দুর্নীতি কী ধরনের হবে তা সিংহভাগ ভোটারই বুঝে উঠতে পারেনি। তারা হয়তো ভেবেছে আগের মতোই বাড়তি ভোট অন্তর্ভুক্ত করে প্রার্থীদের অনুকূলে ভোট গণনা করা হবে।

আগের নির্বাচনের স্টাইলে নির্বাচন কমিশনের মাঠ পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তাদের ইচ্ছামতো একটি সংখ্যা বসিয়ে দিয়ে বলবে যে, শতকরা এত ভোট পড়েছে।

এবারের পরিস্থিতি দেখা গেল একটু ভিন্ন। ভোটের ফল বেরোলে কে কত ভোট পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বড় হয়ে দেখা দিল এত কম ভোট কেন পড়েছে। যারা অধীর আগ্রহে ভোটের ফলাফল লক্ষ করছিল তারা হতভম্ব হয়ে দেখল যে, দুই কর্পোরেশনের মিলিত ভোট ২৭ শতাংশের মতো। উত্তর কর্পোরেশনে ২৫+ এবং দক্ষিণে ২৯ শতাংশ। নির্বাচনে যে দল জিতেছে সে দলের সমর্থকরাও বুঝে উঠতে পারছিল না তাদের প্রার্থীকে এত কম লোক কেন ভোট দিয়েছে।

বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যেখানে পুরো মাত্রায় ভোটের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়নি সেখানে ভোট প্রদানের হার সাধারণত ৪০ শতাংশের উপরে হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৩০০ নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ১৫৪টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিল। বাকি নির্বাচনী এলাকায় কাগজে-কলমে নির্বাচন হলেও বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল অতীব নগণ্য।

বিপুলসংখ্যক কেন্দ্রে কোনো ভোটারকেই উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি বলে সংবাদকর্মীরা রিপোর্ট করেছে। কেন্দ্রফেরত পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞেস করে জানা গেছে, তাদের দেখা কেন্দ্রগুলোয় ভোটার ছিল না বললেই চলে। দিনের শেষে ভোটের ফলে দেখা যায়, ভোটারশূন্য কেন্দ্রগুলোয়ও ভোট পড়েছে এবং ভোট গণনা করা হয়েছে।

সামগ্রিক হিসাবে সে নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ৪২ শতাংশ দেখানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বোধহয় ধরে নিয়েছিল, ৪০ শতাংশের নিচে ভোট প্রদান দেখানো হলে সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। কারণ, এর আগে জাতীয় নির্বাচনগুলোয় (’৯৬-এর ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাদে) ৫০ শতাংশ বা তার উপরে ভোট পড়েছিল। সাধারণত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের চেয়েও ভোট বেশি পড়ে। এবারের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন মহাব্যতিক্রম।

এত কম ভোট পড়ার কারণ বিভিন্ন বিশ্লেষক বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ তিন কারণ, কেউ পাঁচ কারণ, কেউ সাত কারণ বলেছেন। তবে একটা বিষয় সুস্পষ্ট- স্বল্প ভোটের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। গবেষণার পরিভাষায় এ ধরনের কারণ বের করাকে Eclectic Approach বলা হয়।

আরও সোজা কথায় একে বলা যেতে পারে Multi Disciplinary Approach to Explain a Phenomenon। গবেষক ও চিন্তকরা একেকজন একেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। তাদের প্রত্যেকের দৃষ্টিতে যেমন যথার্থতা রয়েছে তেমনি অসম্পূর্ণতাও রয়েছে।

সবাই মিলে একসঙ্গে বসে প্রাথমিক কিছু ধ্যান-ধারণা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জড়ো করে বাস্তব সমীক্ষা বা জরিপের মাধ্যমে (Empirical Study) প্রকৃত গ্রহণযোগ্য কারণ বের করতে পারেন। এর জন্য একটি বড় ধরনের প্রকল্প গ্রহণের প্রয়োজন হবে। এটি হবে সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার জন্য সম্পদ বরাদ্দ করতে হবে। তবে জাতীয় স্বার্থে এ ধরনের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা আবশ্যকীয় মনে করি।

এ প্রসঙ্গে একটি তাত্ত্বিক বিষয় আলোচনা ফলপ্রসূ হতে পারে। এবারের দুই কর্পোরেশনেই যন্ত্রের মাধ্যমে ভোট প্রদান করা হয়। যন্ত্রের অনেক খুঁত রয়েছে, ত্রুটি রয়েছে, অসম্পূর্ণতা রয়েছে। যন্ত্র ব্যবহারকারীর বড় রকমের অদক্ষতাও থাকতে পারে। তবে যন্ত্রের বড় গুণ হচ্ছে, এটি প্রায়ই সত্য কথা বলে দেয়। বাস্তব ক্ষেত্রে যা ঘটেছে অকপটে নিখুঁতভাবে তা প্রকাশ করে ফেলে।

এমনও হতে পারে, আমরা এতদিন যা জেনেছি, যা শুনেছি তা পুরো সত্য নয়। যন্ত্র সত্য কথা বলে দিয়ে আমাদের ধ্যান-ধারণাতে একটা বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছে। ইভিএমের মাধ্যমে ভোটদান পদ্ধতিতে দুটি অংশ রয়েছে : ১. পরিচিতি নিশ্চিতকরণ অংশ (Identification part) এবং ২. ভোট প্রদান অংশ (Ballot part)। পরিচিতি নিশ্চিতকরণ অংশে জালিয়াতির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

শুধু প্রিসাইডিং অফিসারের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অংশে (যার একক মাত্র ১ শতাংশ ছিল) এদিক-ওদিক কিছু হতে পারে। ভোট প্রদানের সংখ্যা নিরূপণের ক্ষেত্রে কারচুপি হয়নি বলেই চলে। তবে ভোট প্রদান বা Ballot অংশে বড় রকমের কারচুপির আশঙ্কা ও ব্যবস্থা ছিল।

এখানে স্ব-আরোপিত সাহায্যকারী (Assistant) হিসেবে সব কেন্দ্রেই বাড়তি লোক ছিল। তারা সাহায্যের নামে দ্রুতগতিতে বোতাম টিপে ভোট দিয়ে ফেলেছে, প্রকৃত ভোটার কিছু বোঝার আগেই। প্রকৃত ভোটার ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে তাকিয়ে দেখেছে এবং ঝামেলা না করে বেরিয়ে এসেছে। প্রকৃত ভোটার ছাড়া অন্য কেউ বোতামে টিপ দিলে তা কাজ করবে না- এমন ব্যবস্থা থাকলে হয়তো জালিয়াতি করে ভোট দেয়া সম্ভব হতো না।

ব্যালট অংশে এরূপ চালবাজি ও জালিয়াতির ফলে কেন্দ্র কর্তাদের পছন্দের প্রার্থীর ঘরে চালবাজ সাহায্যকারীরা অতিরিক্ত ভোট গলিয়ে দিয়েছে। ফলে প্রিসাইডিং অফিসার-পোলিং অফিসারদের পছন্দের প্রার্থীরা অন্যায়ভাবে বেশি ভোট পেয়েছে।

আসলে যেসব জাতীয় নির্বাচন নিখুঁত ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে আমরা গর্ববোধ করি সেসব নির্বাচন সামষ্টিক বা Macro পর্যায়ে এ অর্থে সুষ্ঠু হয়েছে যে, সামষ্টিক পর্যায়ের ফলাফলে দেশের আপামর জনসাধারণের পছন্দ ও চিন্তা-চেতনার যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে। ভোটের মূল উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। তবে Micro পর্যায়ে অর্থাৎ কেন্দ্র পর্যায়ে তা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে এমনটি শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

১৯৫৪-এর ভোট থেকে শুরু করে ২০০১ সালের ভোট খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। কেন্দ্র ও নির্বাচনী এলাকা পর্যায়ে ভোট অনুষ্ঠান সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ হয়েছে বলে আমি মনে করি না; কিন্তু গণমানুষের চিন্তা ও পছন্দ সামগ্রিক ফলাফলে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল বলে এ নিয়ে হৈচৈ বা তোলপাড় হয়নি।

এমনও হতে পারে, যে পরিমাণ ভোট প্রদান দেখানো হয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে সত্য নয়। বিভিন্ন রকম কারচুপির (সূক্ষ্ম, স্থূল) মাধ্যমে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা বা শতাংশ বেড়ে গেছে। ভোটের বাক্সে বাড়তি ব্যালট ঢোকানো নির্বাচনে একটি সহনীয় দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ভোটারের পরিচিতি (Identification) মেশিন কর্তৃক যাচাই করার ফলে বাড়তি ভোট বা জাল ভোট প্রদান সম্ভব হয়নি বললেই চলে। তাই সত্যিকার ভোটার কর্তৃক প্রদত্ত ভোটই কেবল গণনায় এসেছে। ফলত ভোট প্রদানের হার কম, যা বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন।

তবে ব্যালট অংশে কারচুপির সুযোগ থাকায় ভোটের বণ্টন বা Distribution দুর্নীতিযুক্ত হয়েছে। সে নিয়ে নানা অভিযোগ ও তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। Ballot অংশ সম্পূর্ণরূপে ত্রুটি ও দুর্নীতিমুক্ত করা গেলে ইভিএমের ভোট গ্রহণযোগ্য মানে উন্নত হতে পারে।

কম ভোট পড়াই স্বাভাবিক ব্যাপার বলে কোনো কোনো দুর্মুখ মন্তব্য করেছেন। বেশি ভোট পড়াকে তারা অসত্য বা অস্বাভাবিক বলে মনে করেন। ষাটের দশকের একটি জনপ্রিয় কবিতার পঙ্ক্তি উচ্চারণ করে তারা বলেন, ‘বধূরে চিনি না তোরে, কুমারী কিনা বিধবা’।

ড. সা’দত হুসাইন : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান