ভেঙেছে পিঞ্জর…

শাহিনুল আশিক:


‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা। উড়েছে পাখি পথও চেনা, নীড়েরই ঠিকানা পাবে কিনা পাখি তা নিজেও জানে না।’ এমন অনেক জনপ্রিয় গান গেয়ে সংগীত জগতে নিজের অবস্থান তৈরি করেন শিল্পী এন্ড্রু কিশোর। একটানা গেয়েছেন ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’ ইত্যাদি। এন্ড্রু কিশোরের শিল্পী জীবনের শুরু ছাড়াও শৈশব ও কৈশোর কেটেছে রাজশাহীতে।


এন্ড্রু কিশোরের জীবনের শুরুটা খুব কাছে থেকে দেখেন, রাজশাহী জেলা শিল্পকলা অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক কালচারাল অফিসার আবদুর রশিদ। তিনি এন্ড্রু কিশোরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান,‘ কয়েক শতাব্দীর পরে একজন এন্ড্রু কিশোর জন্মায়। এক্ষতি অপূরণীয়।’

এন্ড্রু কিশোরের সংগীত জীবনের বিষয়ে তিনি জানান, রেওয়াজ ও চর্চায় ফাঁকি বলে কিছু বুঝতেন না। তার মা অনেক উৎসহ, সাহস, পরিশ্রম দিয়েছেন আজকের এই এন্ড্রু কিশোরকে তৈরি করার পেছনে। কোনোদিন এন্ড্রু কিশোর ঠিকমত রেওয়াজ ও চর্চা না করলে মা দুধ খেতে দিতেন না। এমন গল্প করতো সে নিজেও।

এন্ড্রু কিশোরের প্রথম ওস্তাদ ‘ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু’। এন্ড্রু কিশোর ওস্তাব বাচ্চুর ‘সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়’-এ গান শিখেছেন। এই বিদ্যালয়টি প্রথমে রাজশাহী মহানগরীর ভুবন মোহন পার্কের সামনের দোতালা ভবনে ছিলো। তার পরে বাটার মোড় ও সর্বশেষ বোসপাড়া মোড়ে ছিলো। সেই সময় শুধু এন্ড্রু কিশোর নয়, গান শিখতো এমএ খালেক, রিজিয়া পারভীন, ইফাত আরা নার্গিস, আবদুল খালেক ছানা, হাবিবুর রহমান লাবু, মাইনুল ইসলামসহ আরও অনেকেই।

বিদ্যালয়ে সঙ্গিত চর্চা শেষে একে একে সবাই চলে যেতো। কিন্তু এন্ড্রু কিশোর ‘ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু’র কাছেই বসে থাকতো। ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু খুব ভালোবাসতে এন্ড্রু কিশোরকে। ওস্তাদ বাচ্চু সবটুকু উজার করে দিয়েছে এন্ড্রু কিশোরকে।

তিনি আরও জানান, ১৯৮০ সালে দরগাড়া এলাইট ক্লাবের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য রাজশাহী কলেজে নাটক ‘দুই মহল’ মঞ্চস্থ হয়। এসময় নায়ক রাজ রাজ্জাক, পরিচালক আজাহারুল ইসলাম খান, প্রযোজক মজিবার রহমান চৌধুরী, বাবুল, চিত্র নায়িকা নতুন আসেন। মূলত তহবিল গঠনের জন্য ‘দুই মহল’ নাটক মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকের আগে স্থানীয় শিল্পীদের গান গাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হতো। তখন এন্ড্রু কিশোর, রিজিয়া পরভীন গান পরিবেশন করতেন।

একদিন নায়ক রাজ রাজ্জাক আমাকে (আবদুর রশিদ) বললেন, আপনি এন্ড্রু কিশোরকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তার কণ্ঠ আমার ভালো লেগেছে। চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুযোগ করে দেবো। তারপরে এন্ড্রু কিশোরকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকযাত্রা শুরু হয়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এছাড়া নাটোরে সাকাম নাট্য ও কুমিল্লায় চিড়িয়াখানা নির্মাণের অর্থ সংগ্রহের অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর।

জানা গেছে, এন্ড্রু কিশোরের জন্ম রাজশাহীতে। সেখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। একসময় গানের নেশায় রাজধানীতে ছুটে আসেন। তিনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে রেডিওর তালিকাভুক্ত শিল্পী হন।

এন্ড্রু কিশোরকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শিক্ষক ও গবেষক তসিকুল ইসলাম রাজা জানান,‘ দেশের অনেক বড় ক্ষতি হলো। ১৯৭৭ সালে প্রথম এন্ড্রু কিশোর ও ইফাত আরা নার্গিসকে ‘স্পন্দন সংস্কৃতি সংসদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এন্ড্রু কিশোর ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় সংবর্ধনার কথা স্বীকার করেছেন। এন্ড্রু কিশোর ও ইফাত আরা নার্গিসকে ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চুর শীষ্য হিসেবে এই সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।

প্রসঙ্গত, শিল্পী এন্ড্রু কিশোর আর নেই।আজ সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে রাজশাহীতে বোনের বাড়িতে মৃত্যু বরণ করেন। এর পরে তার মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের হিম ঘরে রাখা হয়।

স/আ