আম নিয়ে ভীতি নয়

আম হল ফলের রাজা। দেখতে আকর্ষণীয় ও খেতে সুস্বাদু হওয়ায় প্রায় সব বয়সী মানুষেরই পছন্দ আম। হিমসাগর, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি, হাঁড়িভাঙা- নানা প্রজাতির বাহারি আমে এখন বাজার ভরপুর। আমপ্রিয় বাঙালি তৃপ্তি নিয়ে নানা আমের স্বাদ নিতে ব্যস্ত থাকে এ সময়।

ইন্দো-বার্মা অঞ্চলে আমের উৎপত্তিস্থল বলে ধারণা করা হলেও আকর্ষণীয় ও পুষ্টিমানের কারণে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল হল আম। বাংলাদেশে প্রায় সব অঞ্চলে আম জন্মে; কিন্তু দেশের উত্তরাঞ্চল, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে এর ব্যাপক চাষ হয়ে থাকে।

সারা দেশেই এখন কমবেশি আম পাওয়া যায়। স্বাদে-গুণে ভরা নানা বৈচিত্র্যের আম এখন দেশ পেরিয়ে ইউরোপেও রফতানি হচ্ছে। আম-বাগানি ও ব্যবসায়ীদের কর্মব্যস্ততায় এ সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক এলাকায় চলছে উৎসবের আমেজ। এত উৎসবের আমেজের মধ্যেও অদৃশ্য এক বিষের ভয়ে এ চিরচেনা উৎসবের কোথাও যেন একটা সংকোচ কাজ করে থাকে।

গবেষণা ছাড়া অনেকের না বুঝে আম নিয়ে এমন অতিকথন আম-বাগানি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আরও বিপৎসংকুল করে তুলছে; কিন্তু আমে আসলে বিষের উপস্থিতি থাকে কি না বা থাকলেও তা আমাদের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর, সে বিষয়ে আমাদের জানা উচিত।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, কয়েক বছর ধরে আমের উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। উত্তরাঞ্চল ছাড়িয়ে আম এখন ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। আমরা এখন আম উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম। এসব ভালো খবর প্রচারের সঙ্গে যোগ হয়েছে অপপ্রচারও। আর এতে ফল নিয়ে নানা অপপ্রচারের কারণে অনেকে আতঙ্কে দেশি আম খাওয়া ছেড়ে দিয়ে বিদেশি নানা ফল কিনে খায়।

গবেষণা ছাড়া আম নিয়ে নেতিবাচক অনেক খবরে দেশীয় ফলের বাজার চলে যাচ্ছে মাফিয়া ডনদের হাতে। আর এতে উপকৃত হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানের আম ব্যবসায়ীরা; যারা ইউরোপে আম রফতানি করে আয় করছে লাখ লাখ ডলার-ইউরো। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ভেজালবিরোধী নানা অভিযানের ফলে আজ ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। নিয়মিত অভিযান ও গণমাধ্যমে প্রচারের সুবাদে কুচক্রী ও অসাধু ব্যবসায়ীরা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির আওতায় এনে এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

কিন্তু আমের মধ্যে কেমিক্যালের ব্যবহার হচ্ছে- এ কথা ভেবে যদি আমরা খাওয়া ছেড়ে দিই, তাহলে আমরা সুলভ ও সহজলভ্যে পাওয়া নানা পুষ্টিগুণ থেকে বঞ্চিত হব। আম নানা পুষ্টি উপাদানে ভরপুর, যা শরীর সুস্থ রাখার পাশাপাশি কর্মশক্তি জোগাতেও সহায়তা করে। প্রতি ১০০ গ্রাম আমে ২৭৪০ মাইক্রো গ্রাম ক্যারোটিন থাকে। এতে ১ দশমিক ৩ গ্রাম আয়রন, ১৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১৬ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ১৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-সি, শূন্য দশমিক ৯ মিলিগ্রাম রিভোফ্লেভিন এবং শূন্য দশমিক ০৮ মিলিগ্রাম থায়ামিন থাকে। এ ছাড়াও পাকা আমে রয়েছে জিংকসহ প্রচুর ভিটামিন বি-১ ও বি-২।

এসব সহজলভ্য পুষ্টি উপাদান না গ্রহণ করার ফলে নানা রোগবালাইয়ের সমস্যা যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনি অপুষ্টিতেও ভুগছে প্রচুর মানুষ। আর করোনাকালের এ সময়ে আমের এসব পুষ্টি উপাদান আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই কেমিক্যাল দিয়ে আম পাকানো হয়েছে- এ অভিযোগে কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া হাজার হাজার মণ আম ধ্বংস করার আগে এ আম খেলে এর ক্ষতিকর মাত্রা কতটুকু, তা নিয়ে আমাদের আরও বেশি ভাবতে হবে।

এবার আসি বাজারের কিছু চাকচিক্য প্রচারণায়। কেমিক্যাল কিংবা কার্বাইড ও ফরমালিনমুক্ত আম- এখন এক ধরনের প্রচারণা মাত্র। আর এসব প্রচারণা চালিয়ে দুষ্টচক্রের ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিচ্ছে বহু টাকা। ইতোমধ্যে ফরমালিন ও কার্বাইডের ব্যবহার আমাদের দেশেসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ রয়েছে। তবে সীমিত পরিসরে এখনও অনেক ব্যবসায়ী অন্য কোনো নামে এদের ব্যবহার করছে বলে জানা যায়। আর ইথোফেন হল বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত ফল পাকানোর রেজিস্টার্ড কেমিক্যাল, নির্দিষ্ট মাত্রায় ফল পাকানোর কেমিক্যাল হিসেবেই তা সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যদিও আমাদের দেশে যেভাবে ইথোফেন ব্যবহার করার কথা, তা না মেনে অনেক সময় ব্যবহার হয়ে থাকে।

তবে বাংলাদেশে কার্বাইড নিষিদ্ধের কারণ হল, এর মধ্যে বিভিন্ন অপদ্রব্যের উপস্থিতি, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া কার্বাইড ফলের মধ্যে প্রবেশ করে না, কার্বাইড হিট উৎপন্নে ব্যবহৃত হয়; যা আম অথবা অন্য ফলকে পাকাতে সাহায্য করে। অন্যদিকে ইথোফেন প্রয়োগ করা হলেও সেটি কম সময়ের মধ্যেই (২৪ ঘণ্টা) নির্ধারিত মাত্রার নিচে চলে আসে। মজার ব্যাপার হল, ইথোফেন এবং কার্বাইডকে তাৎক্ষণিকভাবে মাপার জন্য কোনো যন্ত্র আমাদের দেশে এখনও নেই। আর ইথোফেন কিংবা কার্বাইড দিয়ে পাকানো আমের স্বাদ কিছুটা তারতম্য মনে হলেও এর পুষ্টি উপাদানে খুব বেশি পরিবর্তন হয় না।

আম পাকানোর জন্য ফরমালিন কোনোভাবেই দায়ী নয়। প্রাকৃতিকভাবেই আমের মধ্যে ফরমালডিহাইড থাকায় তা আমকে পাকাতে সাহায্য করে। এছাড়া বাইরে থেকে ফরমালিন প্রয়োগ করা হলেও তা আমের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। এছাড়া গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ফরমালিন, ফল ও শাকসবজিতে কাজ করে না।

এটি শুধু আমিষে কাজ করে। তবে ফরমালিন শোধনে চমৎকার ভূমিকা পালন করায় আমের মধ্যে পচনক্রিয়ায় সাহায্যকারী অণুজীবগুলোর উপস্থিতি কমে যাওয়ায় আমের পচনকাল দীর্ঘ হয় বলে অনেক গবেষক মত দিয়েছেন। এ নিয়ে আরও বিস্তর গবেষণা করে তা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। ফরমালিন নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আর তাই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বাগানি ও ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ না দিতে পারলে অযাচিত বিভিন্ন কেমিক্যালের ব্যবহার রয়েই যাবে।

এখন প্রশ্ন হল, আমে বালাইনাশক বা ছত্রাকনাশক ব্যবহার হলেই কি তা আমাদের জন্য ক্ষতিকর? তিন বছর ধরে আমের মধ্যে বিষক্রিয়ার উপস্থিতি নিয়ে কাজ করা কৃষি গবেষণার কীটতত্ত্ব বিভাগের পেস্টিসাইড অ্যানালাইটিক্যাল ল্যাবরেটরির সিনিয়র বিজ্ঞানী ড. দেলোয়ার হোসেন প্রধান আমাদের জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহকৃত এ গবেষণায় মাত্র ৮-১০ শতাংশ আমের মধ্যে বালাইনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে; যার আবার শুধু ৩-৪ শতাংশ Maximum Residue Limit (MRL) অতিক্রম করেছে।

অর্থাৎ সামগ্রিক হিসাবে হয়তো ১-২ শতাংশ আমের মধ্যে বালাইনাশকের উপস্থিতি আমাদের জন্য ক্ষতিকর। এ ধরনের গবেষণাগুলো আমাদের জাতীয়ভাবে খুব বেশি প্রচার পায় না বলেই আমরা যা খুশি বলে দেই আর এতে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের অর্থনীতি। তাই ঢাকায় একটি ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি স্থাপন করে এসব বিষয়ে আরও বেশি প্রচার করা এখন সময়ের দাবি।

আশার কথা হল, পুষ্টিমান ঠিক রেখে খাবারকে কীভাবে আরও বেশি নিরাপদ রাখা যায়, সে বিষয়ে নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতায় একটি প্রকল্পে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে কাজ শুরু করেছে; যা সফলভাবে সম্পন্ন হলে হয়তো আমরা আরও বেশি নিরাপদ খাদ্যের মান নিশ্চিত করতে পারব।

আম পচনশীল ফল। বেশি পাকা অবস্থায় সংগ্রহ করলে সংরক্ষণকাল কম হয়। অধিকাংশ জাতের আম ১৩-১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ও ৮৫-৯০ শতাংশ আপেক্ষিক আর্দ্রতায় বাঁশের ঝুড়ি, বাস্কেট, খড় বিছানো স্থানে ৩-৫ সপ্তাহ সংরক্ষণ করা যায়। গাছ থেকে সাবধানতার সঙ্গে আম পেড়ে আমের আঠা বা কষ ছড়িয়ে ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রার গরম পানিতে শোধন করে ভালো মতো শুকিয়ে তারপর প্যাকেটজাত করলে এতেও ভালো ফল পাওয়া যায়।

আম পাড়ার পর চুন পানিতে কিছুক্ষণ চুবিয়ে তারপর ভালো মতো শুকিয়ে রাখলে আমের স্টেম অ্যান্ড রট নামক রোগ থেকে বাঁচা যায় বলে মত দিয়েছেন কোনো কোনো গবেষক। এছাড়া আম ও লিচু পানিতে ভালো করে ধুয়ে তারপর খেলে স্বাস্থ্যের জন্য তেমন ঝুঁকি থাকে না। অধিক সতর্কতার জন্য লবণ পানিতে ধুয়ে খাওয়া যেতে পারে। যেহেতু চামড়া ছিলে খাওয়া হয় তাই আমের স্বাস্থ্যঝুঁকি খুবই কম বলে মনে করেন আম নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীরা।

সবশেষে বলতে চাই, অনলাইনে কিংবা কুরিয়ার পরিবহনে আম আনার পর তা পচে গেলে শুধু আমচাষী কিংবা ব্যবসায়ীদের দোষারোপ না করে এর প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করা জরুরি। সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের কঠিন এ পরিস্থিতির মধ্যেও বর্তমানে বাংলাদেশে আমরা সুলভমূল্যে যে আম পাচ্ছি, তার জন্য আম-বাগানি ও ব্যবসায়ীদের অবশ্যই ধন্যবাদ জানানো উচিত।

দেশীয় ফল আম নিয়ে কোনো অপপ্রচার নয়, বরং জেনে-শুনে-বুঝে বালাইনাশকের ব্যবহার নিয়ে মানুষকে সচেতন করে সহজলভ্য এ ফলগুলো বেশি বেশি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আর বাজার থেকে আম কিনে পরিপূর্ণ স্বাদ ও পুষ্টি পেতে চাইলে, অবশ্যই পরিপক্বের নির্দিষ্ট তারিখের আগে আম খাওয়া ও বিপণন বন্ধ করতে হবে।

ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম ও আবদুল কাইয়ুম : নিরাপদ খাদ্য নিয়ে কাজ করা শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের শিক্ষক

mticsau@yahoo.com

 

সুত্রঃ যুগান্তর