ভারতীয় ভ্যাকসিনের ট্রায়াল ও উৎপাদন বাংলাদেশেও

করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) সম্ভাব্য ভারতীয় ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল (পরীক্ষামূলক প্রয়োগ) বাংলাদেশেও করার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। একই সঙ্গে সম্ভাব্য ওই টিকা চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে বাংলাদেশেও এর উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে ভারত।

গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন, সংক্ষেপে জেসিসি) ভার্চুয়াল বৈঠকে ভারত ওই প্রস্তাব দেয়।

বৈঠকে ভারতের পক্ষে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর বলেন, ‘ভ্যাকসিন উদ্ভাবন, ট্রায়াল এবং তা চূড়ান্ত হওয়ার পর উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার অপেক্ষায় আছি। এসব উদ্যোগে বাংলাদেশকে উচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আমরা ভারতে তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরুর পরপরই বাংলাদেশে তা শুরু করতে চাই। অভিন্ন ট্রায়াল আমাদের নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার এবং ভ্যাকসিনের যৌথ উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করবে।’

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভারত তার নিজস্ব ভ্যাকসিন ট্রায়ালের জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে। এটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার সম্ভাব্য ভ্যাকসিন নয়। ওই ভ্যাকসিনের জন্য বাংলাদেশের ওষুধ প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো আগেই চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

ভারতের এই প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের দৌড়ে এগিয়ে থাকা সবার সঙ্গেই বাংলাদেশ যোগাযোগ রাখছে এবং ভ্যাকসিন পাওয়া নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। ভারতের প্রস্তাবেও বাংলাদেশ নীতিগতভাবে স্বাগত জানিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক  বলেন, ভারতের ভ্যাকসিনের বর্তমানে দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে। শিগগিরই সেখানে তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ওই ট্রায়াল বাংলাদেশে চালানোর বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে কারিগরি পর্যায়ে আলোচনা ও প্রশিক্ষণ চলছে।

উল্লেখ্য, চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বাংলাদেশে শুরু করার জন্য সম্ভাব্য ভ্যাকসিন চলতি মাসেই এ দেশে পৌঁছানোর কথা থাকলেও তা পিছিয়ে গেছে। এরই মধ্যে ভারতের সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বাংলাদেশে শুরুর বিষয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী ভার্চুয়াল জেআরসি বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, অভিন্ন নদীর পানির সমস্যা সমাধান এবং সীমান্তে নিহতের সংখ্যা শূন্যে কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ও ভারত সম্মত হয়েছে। তিনি বলেন, অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের সমাধান ছাড়াও তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি দ্রুত সমাধানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ। উভয় পক্ষই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বাসস্থানে দ্রুত নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, সীমান্তে হত্যা উভয় দেশের জন্য লজ্জার। জানা গেছে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেসিসি বৈঠকে বলেছেন, সীমান্তে যেকোনো মৃত্যু, সেটি ভারতীয় বা বাংলাদেশির, যারই হোক না কেন, তা দুঃখজনক। উভয় পক্ষই সীমান্তে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিরুৎসাহ করবে। আগামী অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে ভারতের স্বরাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশ সফরে আসবেন। সে সময় এ বিষয়ে আরো আলোচনা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ভারত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। এ ছাড়া অন্যান্য নদীর পানিবণ্টনের বিষয়ে আলোচনার আগ্রহ দেখিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশনের (জেসিসি) বৈঠক বহু বছর ধরে হচ্ছে না। ওই বৈঠক অনুষ্ঠানের আগে ভারত দুই দেশের কারিগরি পর্যায়ে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছে। সেখানে তিস্তার বাইরে সাতটি নদীর পানির তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আগামী ১৬ ডিসেম্বর ভারত একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করবে।

এদিকে গতকালের জেসিসি বৈঠকে ভারতীয় পক্ষ বাপু-বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল জাদুঘরের ভিডিও দেখিয়েছে। এটি ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হলে এই দুই দেশ ছাড়াও বিশ্বের লোকজন বঙ্গবন্ধু ও মহাত্মা গান্ধী এবং তাঁদের জীবন সম্পর্কে আরো জানতে পারবে।

জানা গেছে, শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক নির্মাণের অগ্রগতি নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। ওই বায়োপিকের শুটিং শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কভিডের কারণে পিছিয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের বিষয়েও কথা হয়েছে জেসিসি বৈঠকে। বাংলাদেশ ওই ডকুমেন্টারি নির্মাণের জন্য একজন পরিচালক মনোনয়ন দেবে।

ভিসা ইস্যুতেও আলোচনা হয়েছে জেসিসি বৈঠকে। ভারত তার প্রস্তাবিত এয়ার বাবল চুক্তির কথা বলেছে। কতগুলো ফ্লাইট, কোন কোন গন্তব্যে যাবে, সেসব বিষয়ে এখন দুই দেশের মধ্যে কারিগরি পর্যায়ে যোগাযোগ হচ্ছে।

বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত পথে যাতায়াত শুরুর কথা বললেও নয়াদিল্লি সূত্রগুলো বলছে, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এখন এ বিষয়টি বেশ জটিল। কারণ যাত্রীদের কোয়ারেন্টিনসহ অনেক বিষয় আছে। তা ছাড়া ভারতে রাজ্যগুলোর আলাদা নিয়ম আছে।

গতকালের জেসিসি বৈঠকে ভারতের ঋণের অর্থে প্রকল্প বাস্তবায়ন তদারকির জন্য বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ও ভারতীয় হাইকমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। জানা গেছে, ভারতের প্রতিশ্রুত ৭৬০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের মধ্যে এ পর্যন্ত ছাড় হয়েছে মাত্র ৭০ কোটি ডলার। এ পর্যন্ত নেওয়া ৪৬টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ১৪টি বাস্তবায়িত হয়েছে। ১২টি এখনো ডিপিপি মূল্যায়ন পর্যায়ে আছে।

বৈঠকে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশেই আলোচিত পেঁয়াজের প্রসঙ্গও ওঠে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ভারতকে অনুরোধ জানায়, পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের আগে বাংলাদেশকে যেন আগেভাগে জানানো হয়।

জেসিসি বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কনস্যুলার ইস্যুতে বৈঠক করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মহাত্মা গান্ধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশের একটি স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করেন।

আগামী বছর মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি যৌথভাবে উদযাপনের এবং বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়াও অন্য দেশগুলোতে নিজ নিজ মিশনে অনুষ্ঠান আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। উভয় পক্ষ বেশ কিছু অনুষ্ঠান যৌথভাবে আয়োজনের বিষয়ে আলোচনা করেছে। এগুলোর মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা ও নয়াদিল্লি বা কলকাতায় আনুষ্ঠানিক সামরিক কুচকাওয়াজ, ১৯৭১ সালের ভারতীয় যুদ্ধবীরদের সম্মান জানানো, মুজিবনগরে স্থায়ী ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতা সরণি উদ্বোধনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক মুজিবনগর-কলকাতা সড়ক আবারও চালু করা, দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ে মৈত্রী মেলা বা মিলনমেলা আয়োজন করা, ১৯৭১ সালের প্রবীণ যোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন শহরে বছরব্যাপী সেমিনারের আয়োজন করা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও তথ্য-উপাত্তসংবলিত বিজয় ও বন্ধুত্বের ৫০ বছরের ওয়েবসাইট চালু করা উল্লেখযোগ্য।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ